ঠাকুর বলতেন, যে রাম, যে কৃষ্ণ হয়েছিল, তিনিই ইদানীং এই খোলটার ভিতর। বলে, নিজের দেহখানি দেখিয়ে দিতেন। তা এমন পুরুষ জিনিস, তিনি নিজের অসুখ সারালেন না কেন! কেন কষ্ট পেলেন কণ্ঠের ক্ষতে! সে-ও এক গল্প। আসুন আমরা ঠাকুরের আর এক ভাবের কথা শুনে নিই।
ঠাকুরের তখন বেশ অসুখ করেছে। যাকে বলে বাড়াবাড়ি। কষ্ট পাচ্ছেন। ভক্তেরা তাঁকে এনে রেখেছেন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে। এইরকম এক দিনে ঠাকুরের কাছে এলেন শশধর তর্কচূড়ামণি। তিনি পণ্ডিত মানুষ। মহাপুরুষদের যে নানা ঐশী ক্ষমতা আছে, তা তিনি জানতেন। ঠাকুর যদিও সিদ্ধপুরুষ, তবু কখনও তো কোনরকম সিদ্ধাই দেখাননি। বরং ওরকম শক্তির প্রকাশকে তিনি মনেপ্রাণে পছন্দ করতেন না।
আরও শুনুন: ঠাকুর বলতেন, সত্যনিষ্ঠা থাকলে জগদম্বা বেচালে পা পড়তে দেন না…
একবার তান্ত্রিক সাধক গৌরী পণ্ডিত এসেছিলেন ঠাকুরের কাছে। তিনি তর্কে প্রবৃত্ত হওয়ার আগে মুখে ‘হা রে রে’ শব্দ করতেন। তাতে অন্যপক্ষ যেমন ঘাবড়ে যেত, তেমনই গৌরী পণ্ডিতের নিজের ভিতর শক্তি জাগ্রত হত। এইভাবেই তিনি বিপক্ষের বলহরণ করতেন বলে শোনা যায়। তর্কে তাই তাঁকে হারানো সহজসাধ্য ছিল না। ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে এসে তিনি যখন মুখে ওই শব্দ করলেন, ঠাকুরও গলা তুলে জোরে হারেরে বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। প্রত্যুত্তরে গৌরী আর একটু গলা তুললে, ঠাকুর আরও জোরে তাঁর জবাব দিলেন। এমন উচ্চরব শুনে তো সেখানে দারোয়ানরা এসে হাজির। ঠাকুরকে শুধু ‘হা রে রে রে’ বলে হারাতে না পেরে গৌরী বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। পরে ঠাকুর বলেছিলেন “ মা জানিয়ে দিলেন, গৌরী যে শক্তি বা সিদ্ধাইয়ে লোকের বলহরণ করে নিজে অজেয় থাকত, সেই শক্তির এখানে ঐরূপে পরাজয় হওয়াতে তার ঐ সিদ্ধাই থাকল না! মা তার কল্যাণের জন্য তার শক্তিটা এর ভিতর টেনে নিলেন।” বলে নিজের দিকে আঙুল তুলে দেখাতেন।
আরও শুনুন: মানুষ কি নিজের মন্দ কাজের ভারও ঈশ্বরের উপর চাপাতে পারে?
সেই ঠাকুরকেই তর্কচূড়ামণি বললেন, “মহাশয়, শাস্ত্রে পড়েছি আপনাদের ন্যায় পুরুষ ইচ্ছামাত্রেই শারীরিক রোগ আরাম করে ফেলতে পারেন। আরাম হোক মনে করে মন একাগ্র করে একবার অসুস্থ স্থানে কিছুক্ষণ রাখলেই সব সেরে যায়। আপনার একবার ঐরূপ করলে হয় না?” ঠাকুর তাঁকে বললেন, “তুমি পণ্ডিত হয়ে একথা কি করে বললে গো? যে মন সচ্চিদানন্দকে দিয়েছি, তাকে সেখান থেকে তুলে এনে এ ভাঙা হাড়-মাসের খাঁচাটার উপর দিতে কি আর প্রবৃত্তি হয়?”
আরও শুনুন: অবতার বলেই গিরিশের বকলমা নিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
তর্কচূড়ামণি তো এই শুনে চলে গেলেন। কিন্তু ভক্তেরা ছাড়বেন কেন! ঠাকুরের প্রিয় ভক্ত স্বামীজী খুব করে ধরে বসলেন। বললেন, আপনাকে অসুখ সারাতেই হবে, আমাদের জন্য সারাতে হবে। ঠাকুর বললেন, আমার কি ইচ্ছা রে যে, আমি রোগে ভুগি; আমি তো মনে করি সারুক, কিন্তু সারে কই? সারা, না সারা, মা-র হাত। স্বামীজী তখন বললেন, তবে মাকে বলুন সারিয়ে দিতে, তিনি আপনার কথা শুনবেনই শুনবেন। ঠাকুর ভক্তের কথা ফেলতে না পেরে বললেন, তোরা তো বলছিস, কিন্তু ও কথা যে মুখ দিয়ে বেরোয় না রে! স্বামীজী জোর দিয়ে তখন বললেন, তা হবে না মশাই, আপনাকে বলতেই হবে। আমাদের জন্য বলতে হবে।
ঠাকুর বললেন, আচ্ছা, দেখি, পারি তো বলব।
আরও শুনুন: কেন কল্পতরু হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ?
খানিকক্ষণ পর স্বামীজী পুনরায় ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলেন, “মশায়, বলেছিলেন? মা কী বললেন?” ঠাকুর নিজের গলার ক্ষত দেখিয়ে বললেন, মাকে বললুম, ‘এইটের দরুন কিছু খেতে পারি না; যাতে দুটি খেতে পারি করে দে।’ তা মা বললেন – তোদের সকলকে দেখিয়ে – ‘কেন? এই যে এত মুখে খাচ্চিস!’ আমি আর লজ্জায় কথাটি কইতে পারলুম না।
এই হল ঠাকুরের অদ্বৈতজ্ঞানের দৃষ্টান্ত। অপূর্ব ভাব। তাঁর আরাধ্যা তাঁকে বলছেন, – ‘এই যে এত মুখে খাচ্চিস!’ – এই শুনেই ঠাকুর লজ্জা পেয়ে গেলেন। তাঁর তো ‘আমি’ বোধ থাকার কথাই নয়, একটা ক্ষুদ্র শরীরকে তিনি আমি বলে বোধ করবেন কেন! যিনি মহাপুরুষ তাঁর এই ভাব কল্পনা করাও যেন আমাদের সাধ্যাতীত। তাই বুঝি তিনি বলতেন, যে রাম, যে কৃষ্ণ হয়েছিল, তিনিই ইদানীং এই খোলটার ভিতর। অপূর্ব ভাবরাশির সম্মিলন তাই আমাদের ঠাকুর, যুগাবতার রামকৃষ্ণ।