শোনালেন এক আশ্চর্য ঘটনার কথা। বললেন, কতবার এমন হয়েছে যে, তিনি ঘরে শুয়ে আছেন। খিল দিয়ে বিছানায় শুয়ে, সেই অবস্থাতেই ডাক পড়ল ঠাকুরের। না, সাধারণ কোনও ডাক নয়। নরেন্দ্রনাথ বলছেন, শরীরের ভিতর যেটা আছে, সেটাকে আকর্ষণ করে তিনি দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে গেলেন। অনেক কথা অনেক উপদেশের পর তবে ফিরতে দিলেন। নরেন্দ্রনাথ তাই তো বলেন, তিনি সব পারেন। দক্ষিণেশ্বরের গোরা রায় সব করতে পারেন।
যুবক নরেন্দ্রনাথ যেন ক্রমশ বদলে যাচ্ছেন। যেদিন ঠাকুরকে প্রথম গান শুনিয়েছিলেন, সেদিন কল্পনা করতেও পারেননি যে, ওই মানুষটা তাঁকে এমন পালটে দেবেন। কত না বিষয়ে কথা হয়েছে ঠাকুরের সঙ্গে। নরেন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বাসে অটল থেকেছেন। যুক্তি থেকে এতটুকু সরেননি। তর্ক করেছেন। ঠাকুর সবই দেখেছেন, বুঝেছেন। তারপর কী এক ঐশী ক্ষমতাবলে বদলে দিয়েছেন নরেন্দ্রনাথকে। এর আগেও ঠাকুরের স্পর্শে ভাবান্তর হয়েছে তাঁর। নরেন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছেন, বাইরে থেকে নয়, তাঁর ভিতরটাকেই যেন বদলে দিচ্ছেন ঠাকুর। আরও একবার সেই ঘটনারই সাক্ষী থাকলেন। ঠাকুরের স্পর্শে যখন অদ্বৈতিবিজ্ঞান নিয়ে তাঁর আর কোনও সন্দেহ থাকল না, তখন নরেন্দ্রনাথ যেন বুঝতে পারলেন, ঠাকুরের অভিপ্রায়। ঠাকুর যেভাবে চিনেছিলেন নরেন্দ্রনাথকে, সেভাবে তো আর কেউ চিনতে পারেননি। একই ভাবে নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে পরিচয় পাচ্ছেন, তাও অন্য কারও পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৩): ঠাকুরের স্পর্শে আচ্ছন্ন নরেন্দ্রনাথ… মা ভাবলেন, ছেলে বুঝি বাঁচবে না!
একবার সে কথা নরেন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন তাঁর সতীর্থদের। তাঁরা গোড়া থেকেই নরেন্দ্রনাথের প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করতেন। সেদিনের ঘটনা শোনার পর থেকে তা আরও বেড়ে গিয়েছিল। সতীর্থদের সঙ্গে নিয়ে নরেন্দ্রনাথ সেদিন গিয়েছেন হেদুয়ার পুকুরপাড়ে। ঘোরাঘুরি হচ্ছে আর সেই সঙ্গে চলছে ঈশ্বর আলোচনা। কথায় কথায় চলে এল ঠাকুরের প্রসঙ্গ। নরেন্দ্রনাথ বলতে শুরু করলেন, ঠাকুরের স্পর্শে এযাবৎ তাঁর কী কী দিব্য অনুভূতি হয়েছে – সেই বৃত্তান্ত। সেই কথা শুনে সকলেই শিহরিত। বলতে বলতেই নরেন্দ্রনাথ হঠাৎ মগ্ন হয়ে গান গাইতে শুরু করলেন। সকলেই শুনছেন, তন্ময় হয়ে নরেন্দ্রনাথ গাইছেন-
প্রেমধন বিলায় গোরা রায়!
চাঁদ নিতাই ডাকে আয় আয়!
(তোরা কে নিবি রে আয়!)
প্রেম কলসে কলসে ঢালে তবু না ফুরায়!
প্রেমে শান্তিপুর ডুবু ডুবু
নদে ভেসে যায়!
(গৌর-প্রেমের হিল্লোলেতে)
নদে ভেসে যায়!”
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১২): ঠাকুরের সঙ্গেও তর্ক করতেও ছাড়তেন না যুবক নরেন্দ্রনাথ
গান শেষ হলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর নিজের মনেই বলতে থাকলেন, সত্যিই প্রেম বিলোচ্ছেন একজন মানুষ। তাঁর ইঙ্গিত ঠাকুরের প্রতিই। নরেন্দ্রনাথ বলছেন, প্রেম বলো, ভক্তি বলো, জ্ঞান বলো, মুক্তি বলো, গোরা রায় যাকে যা ইচ্ছা তাকে তা-ই বিলোচ্ছেন! কী অদ্ভুত শক্তি তাঁর। বলেই শোনালেন এক আশ্চর্য ঘটনার কথা। বললেন, কতবার এমন হয়েছে যে, তিনি ঘরে শুয়ে আছেন। খিল দিয়ে বিছানায় শুয়ে, সেই অবস্থাতেই ডাক পড়ল ঠাকুরের। না, সাধারণ কোনও ডাক নয়। নরেন্দ্রনাথ বলছেন, শরীরের ভিতর যেটা আছে, সেটাকে আকর্ষণ করে তিনি দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে গেলেন। অনেক কথা অনেক উপদেশের পর তবে ফিরতে দিলেন। নরেন্দ্রনাথ তাই তো বলেন, তিনি সব পারেন। দক্ষিণেশ্বরের গোরা রায় সব করতে পারেন।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১১): অন্য ভক্তদের সঙ্গে তর্ক করুক নরেন্দ্রনাথ, এ যেন ছিল ঠাকুরেরও ইচ্ছা
আর নরেন্দ্রনাথের মুখে এ কথা শুনে তো বিস্মিত তাঁর সতীর্থরা। ঠাকুর যে সিদ্ধপুরুষ সে কথা সকলেই জানতেন। তিনি তবু ঠিক কতটা ক্ষমতার অধিকারী আজ যেন তার পরিচয় পেলেন সকলে। শ্রীচৈতন্যের মতো জগদগুরু জীবনে যে সব অলৌকিক ঘটনা ঘটত, যা শুধু পড়া যায়, আর পড়ে অবিশ্বাস হয়, সেরকম দিব্য ঘটনা ঠাকুরের জীবনেও নিত্য ঘটছে। এই উপলব্ধি এবার পাকা হল। তিনি চাইলেই স্পর্শ করে কাউকে সংস্কারমুক্ত করে তুলতে পারেন। আর তার সবথেকে বড় উদাহরণ তো সকলের সামনেই বসে আছেন। ঠাকুরের সেই প্রকল্পের নামই নরেন্দ্রনাথ। তিনি তৈরি হচ্ছেন জগতের সংস্কার মোচনের জন্য। সকলেই যেন অনুভব করেন, পৃথিবীতে আসছে নতুন দিনের ভোর।