জ্ঞানীজন যাঁরা, তাঁরা বলে থাকেন, মানুষ যন্ত্র মাত্র। যন্ত্রী স্বয়ং ঈশ্বর। অন্তত সেভাবেই, সেই দৃষ্টিভঙ্গি মেনেই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। কেউ কেউ আবার এই কথার ভুলব্যাখ্যা করেন। নিজের মন্দ কাজের ভারও চাপিয়ে দিতে চান ঈশ্বরের উপর। কিন্তু সত্যিই কি এরকমটা সম্ভব? এই ফাঁকি কি ধরা পড়ে যায় না? একবার চমৎকার এক গল্পে আমাদের এ কথাটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। আসুন, শুনে নিই।
ভক্তপ্রবর গিরিশ ঘোষের বকলমা নিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। যার অর্থ ঠাকুর, ভক্তের সমস্ত ভার নিয়েছিলেন। অনেকে আবার এই দৃষ্টান্ত সামনে রেখে মনে করেন, নিজ কৃতকর্মের সমস্ত ভারই তবে ঈশ্বরের। কেননা ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই তো সকল কর্ম। এ যেন একরকমের ছাড়পত্র, যা কিনা যা-ইচ্ছা-তাই করার অধুকার দেয়। কিন্তু এ আসলে মানুষের নিজের তৈরি ব্যাখ্যা। ঈশ্বরের ইচ্ছায় কর্ম করা মানেই যা খুশি করা নয়। এই কথাটি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একবার বুঝিয়েছিলেন গল্পে।
আরও শুনুন: অবতার বলেই গিরিশের বকলমা নিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
গল্পটি এক ব্রাহ্মণের। তাঁর বাগান করার শখ। অনেক খেটেখুটে তিনি চমৎকার একটি বাগান করেছিলেন। গাছগাছালিতে ভর্তি। চমৎকার ফুল ফুটেছে। বাগান দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। একদিন সেই বাগানে ঢুকে পড়ল একটা গরু। ব্রাহ্মণ তখন ছিলেন ঘরের বাইরে। তিনি ফিরে এসে দেখেন, গরুটি মনের আনন্দে তাঁর সাধের গাছপালা খেয়ে তছনছ করছে। দেখে ব্রাহ্মণের খুব রাগ হল। তিনি একটা লাঠি হাতে গরুটিকে তাড়া করলেন, আর রাগ সামলাতে না পেরে প্রাণীটিকে আঘাতও করে ফেললেন। মর্মস্থানে লাগল আগাত, তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হল গরুটির।
আরও শুনুন: কেন কল্পতরু হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ?
এবার তো ব্রাহ্মণ পড়লেন মহা সংকটে। গোহত্যার পাপ যে তাঁকে স্পর্শ করবে, তা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। কী এর পরিণতি হতে পারে, ভেবে যখন তিনি শঙ্কিত, তখন আচমকা একটা ভাবনা খেলে গেল তাঁর মনে। তাঁর শাস্ত্রজ্ঞান তাঁকে জানাল, বিশেষ বিশেষ দেবতার শক্তিতেই তো মানুষের অঙ্গসমূহ কাজ করে। যেমন, সূর্যের শক্তিতে চোখ দেখে, পবনের শক্তিতে কান শোনে, তেমনই ইন্দ্রের শক্তিতেই হাত কাজ করে। তাহলে এই যে হত্যা তা তো ইন্দ্রের দ্বারা হয়েছে। তিনি এ কারণে দোষী নন। গোহত্যাজনিত পাপ যখন তাঁর কাছে এল, তখন তিনি এই সিদ্ধান্ত জানালেন। পাপ তখন গেল ইন্দ্রের কাছে। ইন্দ্র সব শুনে বললেন, থামো বাপু! আমি বরং ওই ব্রাহ্মণের সঙ্গে দুটো কথা বলে আসি।
আরও শুনুন: পৃথিবীতে কে আমাদের কাছের মানুষ? উত্তর দিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ
এই না বলে ইন্দ্র ছদ্মবেশে সেই বাগানে এসে হাজির হলেন। ব্রাহ্মণ তখন বাগানে গাছের পরিচর্যাই করছিলেন। এদিকে ইন্দ্র বাগান ঢুকেই খুব তারিফ করা শুরু করলেন। তা শুনে ব্রাহ্মণ তো খুব খুশি। তাঁকে ডেকে ডেকে দেখাতে লাগলেন বাগানের চারিদিক। ইন্দ্র জানতে চাইলেন, এই বাগানটি কার? ব্রাহ্মণ গর্ব করে জবাব দিলেন, এ বাগান আমার। এইরকম কথা হতে হতে ঠিক যেখানে মৃত গরুটি পড়েছিল সেখানে এসে উপস্থিত হলেন তাঁরা। ইন্দ্র তো যেন কিছুই জানেন না। একেবারে চমকে উঠে বললেন, রাম রাম এখানে গোহত্যা কে করল! এবার তো ব্রাহ্মণ পড়লেন ফাঁপরে। এতক্ষণ নিজের বাগান বলে গর্ব করেছেন। ডেকে ডেকে সবকিছু দেখিয়েছেন। ইন্দ্রের সমস্ত প্রশংসা শুনেছেন মন ভরে। এখন অস্বীকার করেন কী করে? তিনি আর কথা বলতে না পেরে চুপ করে গেলেন। তখন ইন্দ্র স্বরূপ ধারণ করে বললেন, রে ভণ্ড, বাগান তোমার, তার যা কিছু ভাল সব তোমার কৃতিত্ব আর কেবল গোহত্যাটিই আমি করেছি! এই না বলে ইন্দ্র তৎক্ষণাত ব্রাহ্মণকে তার পাপ ফিরিয়ে দিলেন। হত্যাজনিত পাপ এবার অবধারিত ভাবেই স্পর্শ করল ব্রাহ্মণকে।
শুনে নিন বাকি অংশ।