সেই স্পর্শে আবার যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল নরেন্দ্রনাথের শরীরে। সেই আগে যেমনটা হয়েছিল, তেমনই। এবার অনেকদিন পরে। স্তম্ভিত হয়ে নরেন্দ্রনাথ দেখতে লাগলেন, ঈশ্বর ভিন্ন বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে আর কিছুই নেই। ভাবলেন, দেখা যাক কদ্দিন এই ঘোর থাকে। ঘোর কিন্তু তাঁর সহজে কাটল না।
ঠাকুর অদ্বৈতবিজ্ঞানের কথা শোনালেও, নরেন্দ্রনাথের তাতে তেমন বিশ্বাস নেই। তিনি তো সবকিছুই যুক্তি দিয়ে বুঝে নিতেন। যা তাঁর যুক্তির সামনে টেকে না, তাতে তাঁর বিশ্বাসও নেই। এই নিয়ে স্বয়ং ঠাকুরের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিতেও তিনি দ্বিধা করতেন না। এদিকে ঠাকুর অপেক্ষা করতেন। ঠাকুর জানতেন, একদিন ঠিক সময় আসবে। সেদিন আর নরেন্দ্রনাথের মনে এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ থাকবে না।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১২): ঠাকুরের সঙ্গেও তর্ক করতেও ছাড়তেন না যুবক নরেন্দ্রনাথ
এর মধ্যে প্রতাপচন্দ্র হাজরার সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের বেশ কথাবার্তা হয়। মেধায়, বুদ্ধিতে, ভক্তিতে- সবদিক থেকেই দুজনের মধ্যে বেশ পার্থক্য। মিল হওয়ার যেন কথাই নয়, অথচ দুজনের বেশ কথা হচ্ছে। দেখেশুনে অন্য ভক্তেরা বলতেন, প্রতাপ হচ্ছেন নরেন্দ্রর ‘ফেরেন্ড’ অর্থাৎ বন্ধু। হাজরা মশায় ঠাকুরের কাছে আসেন বটে, তবে ঠাকুরের কথা যে সব হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন তা নয়। এককালে তাঁর অবস্থা বেশ ভালই ছিল। সেই অবস্থার খানিক অবনতি হয়েছে। হাজরা মশাইয়ের মনে হয়েছিল, ধর্মকর্ম করলে বুঝি আবার খানিক উন্নতি হবে। অর্থাৎ তাঁর ধর্মভাব ছিল সকাম। ঠাকুর এ ব্যাপারে তাঁকে বারবার সাবধান করেছেন। কিন্তু প্রতাপচন্দ্র ভাল বুঝে উঠতে পারেননি সে কথার অর্থ। এমনকী দু-একজন ভক্তের কাছে বলেও ফেলেছেন যে, তিনিও কম সাধু নন। ঠাকুরের কানে গিয়েছে সেই কথা। ঠাকুর তাঁকে বকাঝকা করেছেন, কিন্তু তাড়িয়ে দেননি। এই প্রতাপচন্দ্রকে একটা কারণে পছন্দ করতেন নরেন্দ্রনাথ। প্রতাপ যে মতে বিশ্বাস করতেন, সেখানেই থিতু হতেন। অর্থাৎ তাঁর বিশ্বাসের জোর ছিল পাকা। সহজেই অন্য কোনও কিছু বিশ্বাস করে নিতেন না; এই একটা জায়গায় নরেন্দ্রনাথ যেন তাঁর সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পেতেন। আর তাই দুজনের কথাবার্তাও জমত খুব।
একদিন ঠাকুর আবার অদ্বৈততত্ত্ব নিয়ে কিছু আলোচনা করেছেন। যথারীতি নরেন্দ্রনাথ একমত হতে পারেননি। উঠে গিয়ে পঞ্চবটীতে বসেছেন। পাশেই ছিলেন প্রতাপচন্দ্র। নরেন্দ্রনাথ বললেন, “এরকম কি কখনও হতে পারে? ঘটিটা ঈশ্বর, বাটিটা ঈশ্বর, যাহা কিছু দেখছি এবং আমরা সকলেই ঈশ্বর?” নরেন্দ্রনাথের বলার ধরনে হেসে উঠলেন প্রতাপ। তারপর তিনিও কিছু বললেন। দুজনের মধ্যে পরিহাস-রঙ্গে হাসির রোল উঠল। দূর থেকে সেই ঘটনা দেখছিলেন ঠাকুর। একসময় উঠে এলেন তাঁদের কাছে। পোশাক-আশাক এলোমেলো। যেন ঘোরের মধ্যে আছেন। এদিকে মুখে হাসিটি লেগে আছে। বললেন, এই তোরা কী বলছিস রে? বলেই হাসতে হাসতে নরেন্দ্রনাথকে স্পর্শ করে সমাধিস্থ হলেন।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১১): অন্য ভক্তদের সঙ্গে তর্ক করুক নরেন্দ্রনাথ, এ যেন ছিল ঠাকুরেরও ইচ্ছা
আর সেই স্পর্শে আবার যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল নরেন্দ্রনাথের শরীরে। সেই আগে যেমনটা হয়েছিল, তেমনই। এবার অনেকদিন পরে। স্তম্ভিত হয়ে নরেন্দ্রনাথ দেখতে লাগলেন, ঈশ্বর ভিন্ন বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে আর কিছুই নেই। ভাবলেন, দেখা যাক কদ্দিন এই ঘোর থাকে। ঘোর কিন্তু তাঁর সহজে কাটল না। বাড়িতে ফিরে এলেন। খেতে বসেছেন। কিন্তু খাবেন কী করে! দেখলেন, অন্ন, থালা, যিনি পরিবেশন করছেন, আর যিনি খাচ্ছেন অর্থাৎ স্বয়ং তিনি – কেউ আলাদা নন। সব একজনই। দু-এক গ্রাস খাবার মুখে পুরে চুপ করে বসে থাকেন। মা শুধোন, খাচ্ছিস না কেন রে? তখন হুঁশ ফেরে। আবার একটু খাবার মুখে তোলেন। কী যে হল আবার নরেন্দ্রনাথের! হাত-পা যেন অসাড় হয়ে আছে। রাস্তায় বেরোলে মনে হয়, গাড়ি-ঘোড়ার ভয়ও নেই। আগে মনে হত, এই বুঝি রাস্তা পেরোনোর সময় গাড়ি ঘাড়ে এসে পড়ে। এখন মনে হয়, সবই তো এক, প্রভেদ কিছু নেই। এক-একদিন খেতে পারেন না। কোনোদিন আবার বেশি খেয়ে ফেলেন। নরেন্দ্রনাথের মা মনে মনে ভাবেন, ছেলের বিষম কোনও অসুখ হয়েছে। নইলে এমন করবে কেন! এক একবার তাঁর মনে হয়, ছেলে বুঝি আর বাঁচবে না। এদিকে নরেন্দ্রনাথ সেই আচ্ছন্ন ভাবের মধ্যেই আছেন। জগৎটাকে মনে হয় স্বপ্ন। আচ্ছন্ন দশা একটু কমলে, হেদুয়ার পুকুরপারের লোহার গেটে মাথা ঠুকে দেখতেন। যা দেখছেন তা সত্যি না স্বপ্ন! এইরকম চলল বেশ কিছুদিন। যখন প্রকৃতিস্থ হলেন, নরেন্দ্রনাথ বুঝলেন এই হল সেই অদ্বৈতবিজ্ঞান। যার কথা ঠাকুর তাঁকে বলতেন। শাস্ত্রে যা লেখা আছে, সব সত্যি; মিথ্যা নয়। তিনি নিজেই তো সেই প্রমাণ পেলেন। এবার আর কোনও সন্দেহ নেই। নিশ্চিন্ত হলেন নরেন্দ্রনাথ।
নরেন্দ্রনাথের সেই ভাবান্তরে অলক্ষে বুঝি হাসলেন ঠাকুর। তিনি তো জানতেনই, যাঁকে জীবজ্ঞানে শিব সেবা করতে হবে ভবিষ্যতে, তাঁকে এই অদ্বৈত উপলব্ধিতে একদিন না একদিন ঠিক পৌঁছতেই হবে।