নরেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজের কর্মধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঠিক করেছিলেন, বিশ্বাস রাখবেন একমাত্র নিরাকার ঈশ্বরে। সেইমতোই করবেন ঈশ্বরের উপাসনা। ব্রাহ্মসমাজের অঙ্গীকারপত্রে সইও করেছিলেন। তবে সমাজ নির্ধারিত প্রত্যেকদিনের যে আচার-বিচার তা নিয়ে তিনি খুব একটা যে সন্তুষ্ট ছিলেন তা নয়।
নরেন্দ্রনাথের তর্কপ্রিয় মন ছিল ঠাকুরের ভারি পছন্দের। সে সত্যপ্রাণ। যা তাঁর কাছে যুক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়, সে সব কথায় বিশ্বাস নেই নরেন্দ্রনাথের। তাঁর তো ভাবের ঘরে চুরি নেই। ঠকুর তাঁর প্রিয় শিষ্যের এই মনোভাবের প্রশংসাই করতেন মনে মনে। নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে অন্য ভক্তদের তর্ক বাধিয়ে দিয়ে দূর থেকে যাচাই করে নিতেন তাঁর ক্ষমতা। অবশ্য তিনি নিজেও বাদ যেতেন না। নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও তর্কে প্রবৃত্ত হতেন। ঠাকুর বুঝি তা চাইতেনও। যা কিছু সংশয়, সন্দেহ দূর হয়ে যাক। নরেন্দ্রনাথের অন্তর হয়ে উঠুক স্বচ্ছ। এই ছিল ঠাকুরের চাওয়া। তার জন্য যদি নরেন্দ্রনাথের যুক্তির সামনে তাকে পড়তে হত, তো তা-ও সই।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১১): অন্য ভক্তদের সঙ্গে তর্ক করুক নরেন্দ্রনাথ, এ যেন ছিল ঠাকুরেরও ইচ্ছা
ঠাকুরের ভক্ত রাখালচন্দ্রের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের অনেক আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তখন নরেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজের কর্মধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঠিক করেছিলেন, বিশ্বাস রাখবেন একমাত্র নিরাকার ঈশ্বরে। সেইমতোই করবেন ঈশ্বরের উপাসনা। ব্রাহ্মসমাজের অঙ্গীকারপত্রে সইও করেছিলেন। তবে সমাজ নির্ধারিত প্রত্যেকদিনের যে আচার-বিচার তা নিয়ে তিনি খুব একটা যে সন্তুষ্ট ছিলেন তা নয়। এমত পরিস্থিতিতেই ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর দেখা। কিন্তু নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা থেকে তখনও পুরোপুরি সরে আসেননি নরেন্দ্রনাথ। এদিকে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর রাখালচন্দ্রও সেই একই পদ্ধতিতে উপাসনার দিকে এগিয়ে গেলেন। সই করলেন ব্রাহ্মসমাজের অঙ্গীকারপত্রে। কিন্তু মনে মনে তাঁর সাকার উপাসনার বাসনাও ছিল। বলা যায়, সাকার-নিরাকারের দ্বন্দ্ব তাঁর মধ্যেও ছিল। ফলে ঈশ্বর উপাসনার কোনও একটা মাত্র পথে তিনি থিতু হতে পারেননি তখনও। এর মধ্যে রাখালচন্দ্রও ঠাকুরের কাছে নিয়মিত আসা যাওয়া শুরু করেছেন। একদিন নরেন্দ্রনাথ দেখলেন, রাখালচন্দ্র ঠাকুরের সঙ্গে মন্দিরে গিয়েছেন। আর সমস্ত দেববিগ্রহকে প্রণাম করছেন। দেখে নরেন্দ্রনাথ তো অবাক! যিনি নিরাকার উপাসনায় অঙ্গীকারবদ্ধ, তাঁর আবার এমন সাকার উপাসনার রীতিতে মতি কেন? রাখালকে ডেকে সে প্রশ্ন করলেন নরেন্দ্রনাথ। এদিকে তেজস্বী নরেন্দ্রনাথকে খানিক সমঝেই চলতেন রাখাল। তিনি এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু তাই বললেন না। নরেন্দ্রনাথ রায় দিলেন, রাখাল যা করেছেন তা হল মিথ্যাচার। এই দূষণের ভার গিয়ে পড়েছে রাখালের উপর। এই ঘটনার পর রাখাল নরেন্দ্রনাথকে দেখলেই যেন একটু ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকেন।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১০): কেন নরেন্দ্রনাথকে অবাধ স্বাধীনতা দিতেন ঠাকুর?
রাখালের এই ভাব ঠাকুরের নজর এড়াল না। একদিন তিনি রাখালকে জিজ্ঞেস করে পুরো ঘটনাটি জেনে নিলেন। তারপর নরেন্দ্রনাথকে আলাদা করে বললেন, দেখ, রাখালকে আর কিছু বলিসনি, সে তোকে দেখলেই ভয়ে জড়সড় হয়; তার এখন সাকারে বিশ্বাস হয়েছে, তা কী করবে, বল; সকলে কি প্রথম হইতে নিরাকার ধারণা করিতে পারে?’ কিন্তু নরেন্দ্রনাথ তো নিজ বিশ্বাসে স্থির। ঠাকুর তখনই তাঁকে টলাতে পারলেন না। এদিকে ঠাকুর জানেন, নরেন্দ্রনাথের আধার কেমন। এই উত্তম অধিকারীকে অদ্বৈত তত্ত্বে বিশ্বাস করানোর সংকল্প মনে মনে গ্রহণ করলেন ঠাকুর। দক্ষীনেশ্বরে এলে নরেন্দ্রনাথকে তিনি কিছু কিছু বই পড়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু সে সব বই পড়ে নরেন্দ্রনাথ পালটা বলেন, ‘এতে আর নাস্তিকতাতে তফাৎ তাহলে কী থাকল? সৃষ্ট জীব আপনাকে স্রষ্টা বলে ভাববে? এর থেকে বেশি পাপ আর কি হতে পারে? আমি ঈশ্বর, তুমি ঈশ্বর, জন্ম-মরণশীল যাবতীয় পদার্থ সকলই ঈশ্বর – এর থেকে অযুক্তিকর কথা আর কী হবে? গ্রন্থকর্তা ঋষিমুনিদের নিশ্চয় মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, নতুবা এমন সকল কথা লিখবেন কেমন করে?”
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৯): নরেন্দ্রনাথের জন্য হাসিমুখে লাঞ্ছনাও ভোগ করেছিলেন ঠাকুর
ঠাকুর জানেন, নরেন্দ্রনাথ অন্যরকম। একদিনে তাকে বশ করা যায় না। কিন্তু এই মতে যে নরেন্দ্রনাথকে ফিরতেই হবে, সে কথাও তিনি বেশ ভালোই জানেন। নরেন্দ্রনাথ যখন ঠাকুরের সঙ্গে ওরকম তর্ক করেন, তখন খানিক খুশিই হন ঠাকুর। আর শান্ত করানোর চেষ্টা করেন নরেন্দ্রনাথকে। বলেন, ‘তা তুই ঐ কথা এখন নাই বা নিলি, তা বলে মুনিঋষিদের নিন্দা ও ঈশ্বরীয় স্বরূপের ইতি করিস কেন? তুই সত্যস্বরূপ ভগবানকে ডেকে যা, তারপর তিনি তোর নিকটে যে ভাবে প্রকাশিত হবেন, তাই বিশ্বাস করবি।” বললেন বটে ঠাকুর। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ শুনলে তবে তো! যা তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝতে পারেন না, তাতে তিনি বিশ্বাসই বা রাখবে কেমন করে! নরেন্দ্রনাথ তাই তাঁর যুক্তিতে অটল রইলেন। অলক্ষে হাসলেন ঠাকুর। নরেন্দ্রনাথের এই সংশয়ও যে অচিরেই কেটে যাবে তা তো তিনিই শুধু জানেন। শুধু সময়ের অপেক্ষা। নরেন্দ্রনাথের আসার জন্য যেমন তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল, তাকে তৈরি করতেও তাই খানিক অপেক্ষা করতে হবে। জানেন ঠাকুর, তিনি অপেক্ষা করেন শুধু সেই সঠিক মুহূর্তটির।