জীবজ্ঞানে শিব সেবা। এই মন্ত্র ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের। আর শ্রীশ্রী মা সারদা শিখিয়ে দিয়েছিলেন আর-এক মহামন্ত্র- ‘জগৎ তোমার’। সেই মন্ত্র অনুসরণ করলেই আমরা পাই মানুষ হিসাবে আমাদের কর্তব্য, করণীয় ঠিক কী! যুগের নিরিখে ধর্মপালনের অভিমুখ ঠিক কোনটি। আর এ-কথা মা শুধু মুখে বলেননি, কাজে তা করেও দেখিয়েছিলেন। আসুন শুনে নিই স্নেহশীলা মায়ের কথা।
মা সারদা বলতেন, তিনি সকলের মা। তাঁর কাছে কেউ ছোট-বড় নেই, উচ্চ-নীচ নেই। নরনারায়ণ সেবার মন্ত্র একদিকে ভক্তদের উদ্বুদ্ধ করেছেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। জগতের প্রয়োজনে বদলে দিয়েছেন ধর্মের অভিমুখ। শাস্ত্র সত্যি, সাধনা সত্যি। ঠাকুর বোঝাচ্ছেন, সেই শাস্ত্রলব্ধ জ্ঞান যেন জগতের হিতে লাগে। বহু বহু বছরের সাধনার ধারাটিকে তিনি প্রবাহিত করছেন লোকহিতের প্রতি। আর মা সারদা যেন নিভৃতে বসে ঠাকুরের সেই দর্শনের একটি ব্যবহারিক রূপ তুলে ধরছেন জগতের সামনে। রক্ষণশীলতার বেড়াগুলিকে সরিয়ে দিচ্ছেন নিজের হাতে। খুলে দিচ্ছেন নতুন যুগের নতুন ধর্মের পথ। সে ধর্ম মানুষের ধর্ম। সেখানে স্থান আর্ত পীড়িত সকলেরই। তাই তো তিনি বলেন তিনি সকলের মা। বলেন, ‘জগৎকে আপনার করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার।’ এই যে মা বললেন, ‘জগৎ তোমার’, এটাই যেন মায়ের শিখিয়ে দেওয়া মহামন্ত্র। জগৎকে আপনার করে নিতে জানলেই আসলে নরনারায়ণ সেবার উদ্দেশ্য পূরণ হয়। ঠাকুর যে দর্শনের সলতে জ্বালিয়েছিলেন, মা তার শিখাটিকে ছড়িয়ে দিলেন আমাদের মধ্যে। এ শুধু মায়ের কথার কথা নয়। কতবার নিজের কাজে মা তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। দৃষ্টান্ত রেখেছেন আমাদের সামনে। অজস্র গল্প ছড়িয়ে আছে। আজ শুনি একটা গল্প।
আরও শুনুন: দুষ্ট লোক অনিষ্ট করতে চাইলে ধার্মিক মানুষের কী করণীয়?
শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ-পুঁথি রচয়িতা অক্ষয়কুমার সেন তখন বেশ অসুস্থ। মাকে দেখতে জয়রামবাটী যেতে পারেন না। মায়ের সেবার জন্য কিছু কিছু জিনিস পাঠান। একবার সেরকমই কিছু জিনিসপত্র মায়ের কাছে নিয়ে গেলেন এক মহিলা। তখনকার সমাজ অনুযায়ী তাঁকে ‘নিম্নশ্রেণির শ্রমজীবী’ মহিলা বলা যায়। কিন্তু মায়ের তাতে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। জগৎকে যিনি আলোর শিক্ষা দিতে এসেছেন তিনি এইসব অন্ধকারকেই তো মুছে দেবেন। তাঁর ঘরে তাই কুলি, মজুর, পালকি, বেয়ারা, মেছুনি জেলে সকলেরই ঠাঁই। সকলের জন্য তোলা আছে মায়ের স্নেহ-আদর। তো, ওই মহিলা যখন মায়ের কাছে এলেন মা তাঁকে বললেন, স্নান করে খাওয়া-দাওয়া সেরে, বিশ্রাম নিয়ে তিনি যেন নিজের গ্রামে ফিরে যান। এই আদর পেয়ে বৃদ্ধা তো খুব আনন্দিত। তাঁর খাওয়া দাওয়া সারতে সারতে সেদিনের মতো বেলা পড়ে এল। এদিকে তাঁর আবার হালকা জ্বরও এসেছে। অবেলায় মা তাই তাঁকে বেরোতে নিষেধ করলেন। রাতটুকু থেকে যেতে বললেন। মায়ের ঘরের বারান্দাতেই দরজার পাশে তাঁর শোয়ার বন্দোবস্ত হল। সারাদিনের প্ররিশ্রমে শ্রান্ত সেই মহিলা ঘুমিয়ে পড়লেন অঘোরে।
আরও শুনুন: ঈশ্বরকে মানুষ আর মানুষকে ঈশ্বরের মতো করে দেখার শিক্ষা শ্রীরামকৃষ্ণের
খুব ভোর ভোর উঠে পড়া মায়ের অভ্যাস। সেদিনও ভোররাত্রে মা উঠে দেখেন অসুস্থতার কারণে সেই বৃদ্ধা নিজের বিছানাটি নোংরা করে ফেলেছেন। এদিকে এ কথা জানাজানি হলেই মহিলাকে নানা কথা শুনতে হতে পারে। লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মুখেও হয়তো পড়তে পারেন। মা করলেন কী, চুপিচুপি সেই মহিলাকে জাগিয়ে তুললেন। তাপর তাঁকে বললেন, ভোর ভোর তিনি বেরিয়ে গেলে আর রোদে পথ চলতে তাঁর কোনও কষ্ট হবে না। সেই সঙ্গে খাবার জন্য মুড়ি গুড়ও বেঁধে দিলেন। তিনি মাকে প্রণাম করে চলে গেলেন। মা তখন সেই নোংরা বিছানা নিজের হাতে পরিষ্কার করে দিলেন।
বাকি অংশ শুনে নিন।