একবার নরেন্দ্রনাথ এসে জানালেন, যে তিনি হোটেলে সাধারণ ভাবে যাকে অখাদ্য বলা হয়, তাই-ই খেয়েছেন। ঠাকুর বুঝলেন, নরেন্দ্র আসলে বাহাদুরী করে এই কথা বলছেন না। এরপর তিনি কিছু স্পর্শ করলে পাছে দোষ হয়, বা কেউ তাকে স্পর্শ করলে দোষ হয় – এই সব ভাবনাচিন্তা করেই বলছেন। কিন্তু ঠাকুর এক কথায় সে দোষ নস্যাৎ করলেন। বললেন, ওসব অখাদ্য খাওয়ায় তোর কোনও দোষ হয় না।
নরেন্দ্রনাথের মধ্যে সাক্ষাৎ নারায়ণকেই দেখেছিলেন ঠাকুর। ঠাকুর জানতেন, নরেন্দ্রনাথ এ জগতে ঠিক কোন কাজটার জন্য এসেছেন। বহু পরে তিনি সে কথা স্পষ্ট করে বলেও যাবেন। জানিয়ে দেবেন যে, ‘নরেন্দ্র শিক্ষে দেবে’। সেই গোড়ার দিন থেকেই এই কাজের জন্য যেন তিনি নরেন্দ্রনাথকে তৈরি করছিলেন। তবে এই যে গড়েপিতে নেওয়া, এর পদ্ধতি ছিল বেশ অন্যরকম। সকলের আধার আর নরেন্দ্রনাথ তো এক নন। অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ তিনি। তাই নরেন্দ্রনাথের জন্য ঠাকুরের আলাদা পরিকল্পনা। অন্যরকম নিয়ম-কানুন। বলা যায়, নিয়মহীন সে নিয়ম। নরেন্দ্রনাথের জন্য যা প্রযোজ্য, তা এমনকী নিজের সম্বন্ধেও ভাবতেন না ঠাকুর। ঠাকুর যেন সকলকে বোঝাতে চাইতেন, নরেন্দ্রনাথের পক্ষে যা যা সম্ভব, তা আর কারোর দ্বারাই হয়ে উঠবে না। আর নরেন্দ্রনাথের রাস্তাও তাই আলাদা। গিরিশের যেমন অবিচল ভক্তি এবং অনুরাগ, নরেন্দ্রনাথের ধারা তা থেকে খানিক আলাদা। সে কথা তো পরে বুঝবে গোটা বিশ্ব। ঠাকুর রত্ন চিনেছিলেন। তাকে লালন করছিলেন তার মতো করেই।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৯): নরেন্দ্রনাথের জন্য হাসিমুখে লাঞ্ছনাও ভোগ করেছিলেন ঠাকুর
ঠাকুর বলতেন, নরেন্দ্রনাথ ধ্যানসিদ্ধ। বেনিয়মে ওর দোষ হয় না। নানা কাজেই নরেন্দ্রনাথকে অবাধ স্বাধীনতা দিতেন ঠাকুর। সে শুধু তাঁকে ভালবাসতেন বলেই নয়, তাঁকে নিজের পথ ধরে এগিয়ে যেতেই সাহায্য করতেন ঠাকুর। এক একদিনের ঘটনায় বোঝা যেত, প্রিয় এই শিষ্যকে তিনি কতটা আলাদা ভাবতেন। একবার এক মাড়োয়াড়ি ভক্ত ঠাকুরের জন্য নানা খাবার-দাবার এনেছেন। মিছরি, পেস্তা, বাদাম, কিশমিশ – যাকে বলে এলাহী ব্যাপার। ঠাকুর কিন্তু সেই খাবারের একটি কণাও মুখে তুললেন না। এমনকী কোনও ভক্তকেও তা খেতে দিলেন না। ঠাকুরের মনে হচ্ছিল, এই দানে তখনও কামনা মিশে আছে। নিষ্কাম ভাবে ভক্তটি এখনও দান করে উঠতে পারেননি। তিনি এক খিলি পানও যদি দেন, তো তাতেও কিছু না কিছু কামনা সংযুক্ত হয়ে থাকে। এই খাবার গ্রহণ করলে ভক্তির হানি হবে। তাহলে এত খাবার-দাবার এখন কী হবে? সব কি নষ্ট হবে? ঠাকুর বললেন, সব নরেন্দ্রকে দিয়ে দাও। ও খাক।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৮): নরেন্দ্রনাথের মনের দৃঢ়তা পরীক্ষা করে দেখেও নিতেন ঠাকুর
এই শুনে তো সকলেই বিস্মিত। যা অন্য কোনও ভক্তকে খেতে দিলেন না ঠাকুর, তা নরেন্দ্র খাবে! তাতে তার ভক্তির হানি হবে না? ঠাকুর বললেন, নাহ, ওতে নরেন্দ্রর কোনও ক্ষতি হবে না। সে যে নিত্যসিদ্ধ। তার ভিতর প্রজ্জ্বলিত জ্ঞানের অগ্নি। আহার্যের যা কিছু দোষ সব সেই জ্ঞানের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ঠাকুরের তাই বিশ্বাস, নরেন্দ্রনাথ যেখানে-সেখানে যা-তা যদি খায়ও তাতে তার কোনও ক্ষতি হবে না।
আরও শুনুন- শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৭): ঠাকুরকে গুরু হিসাবে মেনে নিতে সম্মত হলেন নরেন্দ্রনাথ
এখানেই শেষ নয়। একবার নরেন্দ্রনাথ এসে জানালেন, যে তিনি হোটেলে সাধারণ ভাবে যাকে অখাদ্য বলা হয়, তাই-ই খেয়েছেন। ঠাকুর বুঝলেন, নরেন্দ্র আসলে বাহাদুরী করে এই কথা বলছেন না। এরপর তিনি কিছু স্পর্শ করলে পাছে দোষ হয়, বা কেউ তাকে স্পর্শ করলে দোষ হয় – এই সব ভাবনাচিন্তা করেই বলছেন। কিন্তু ঠাকুর এক কথায় সে দোষ নস্যাৎ করলেন। বললেন, ওসব অখাদ্য খাওয়ায় তোর কোনও দোষ হয় না। যদি কেউ অখাদ্য খেয়েও ভগবানে মন রাখে, তবে তার আবার দোষ কী! আর শাক-পাতা খেয়েও যদি কেউ বিষয় বাসনায় ডুবে থাকে, তবে তার দোষ অখাদ্য খাওয়ার থেকে কম কিছু নয়। ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে নিয়মের বাঁধন থেকে ছাড় দিলেন শুধু নয়। আর এক ধাপ এগিয়ে অন্য ভক্তদের দেখিয়ে বললেন, এদের কেউ যদি এসে এই কথা বলত তবে এদের স্পর্শ করতে পারতাম না। কিন্তু তুই অখাদ্য খেয়েছিস, তাতে আমার কিছু মনেই হচ্ছে না। ঠাকুর তো আগেই বলেছেন, বহুবার বলেছেন, যে, জ্ঞানই নরেন্দ্রনাথের খড়্গ। তার ধারেই সে সমস্ত নিত্য বন্ধনকে খণ্ডন করছে। এই জন্যেই মহামায়া তাকে কিছুতেই নিজ আয়ত্তে আনতে পারেন না। নরেন্দ্রনাথ ব্যতিক্রম।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৬): অখণ্ডের রাজ্যে যে ঋষিকে দেখেছিলেন ঠাকুর, তিনিই নরেন্দ্রনাথ
এই যে অবাধ স্বাধীনতা ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন, তাতে আর একটা কাজও হচ্ছিল অলক্ষে। নরেন্দ্রনাথের আত্মবিশ্বাস, পুরুষকার, সত্যপ্রিয়তা শ্রদ্ধাভক্তি বেড়ে চলেছিল শতগুণে। তাঁর প্রতি ঠাকুরের এই যে অসীম বিশ্বাস আর ভালবাসা, তা যেন দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতোই রক্ষা করছিল নরেন্দ্রনাথকে। ঠাকুরের বিশ্বাস তাকে বেঁধে ফেলছিল ক্রমশ। অসীম স্বাধীনতাপ্রিয় নরেন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে সেই প্রেমের বাঁধনে বাঁধা পড়ছিলেন। কোনও হীন কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিলেন। সমস্ত প্রলোভন থেকে সরে যাচ্ছিলেন ক্রমশ। ঠাকুরের প্রেমে যেন আত্মবিক্রয় করছিলেন নরেন্দ্রনাথ। এগিয়ে যাচ্ছিলেন অন্য এক পথে। কিন্তু সেদিন তিনি সেই কথা কতটুকু আর বুঝেছিলেন! বোঝেননি। শুধু যিনি বোঝার তিনিই বুঝতে পারছিলেন। নানা কাজে, ঘটনায়, সিদ্ধান্তে ঠাকুর তাঁর ভক্তকে তৈরি করছিলেন অগ্নিশুদ্ধ করে, নরেন যে জগতকে শিক্ষা দেবে। নরেন্দ্রনাথ তেমন করে বোঝেননি, ঠাকুর সে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন বহু আগেই।