যুগের প্রয়োজনে এমন নতুন কথা যে কেউ বলতে পারেন, তা বোধহয় কল্পনাতেও ছিল না নরেন্দ্রনাথের। তিনি সেদিন তাই বলেছিলেন, ‘আজ যা শুনলাম, সে কথার তাৎপর্যের কোন তুলনাই হয় না। যদি দিন আসে, এই অদ্ভুত বাণীর গভীর রহস্য একদিন সারা জগৎকে শোনাব।’ স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে সে কথা যে তিনি শুনিয়েছিলেন, গোটা বিশ্বই তার সাক্ষী থেকেছে।
শিবজ্ঞানে জীবসেবা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের এই বাণীটি যে তাঁর শিষ্য নরেন্দ্রনাথকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে তো আমরা জেনেছি। বলা যায় যে, এই একটি কথাই স্বামী বিবেকানন্দের সারা জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের সুর বেঁধে দিয়েছিলেন। আমরা এর আগের দুটি পর্বে শুনেছি যে, ঠাকুর নিজের জীবনেও কীভাবে এই কাজ শুরু করেছিলেন। আর্তের পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁদের দুঃখ নিবারণের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। হয়তো মথুরবাবু তাঁর পাশে ছিলেন বলেই তা সম্ভব হয়েছিল। হয়তো দু-একটা ক্ষেত্রেই তিনি এই কাজ করে উঠতে পেরেছিলেন। তবু শুরুটা যে তাঁর হাতেই হয়েছিল, তা অনস্বীকার্য।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৩১): গুরুর বাণীর রহস্য জগৎবাসীকে শোনানোর প্রতিজ্ঞা নরেন্দ্রনাথের
এদিকে প্রথম যেদিন ঠাকুরের মুখে এই মহামন্ত্র শুনলেন নরেন্দ্রনাথ, তিনি মোহিত হয়েছিলেন। তিনি তো নিজে যুক্তিবাদী। নিজে যাচাই না করে কোনও কথা বা মত গ্রহোন করেন না। অগাধ তাঁর শাস্ত্রজ্ঞান। তবু যুগের প্রয়োজনে এমন নতুন কথা যে কেউ বলতে পারেন, তা বোধহয় কল্পনাতেও ছিল না নরেন্দ্রনাথের। তিনি সেদিন তাই বলেছিলেন, ‘আজ যা শুনলাম, সে কথার তাৎপর্যের কোন তুলনাই হয় না। যদি দিন আসে, এই অদ্ভুত বাণীর গভীর রহস্য একদিন সারা জগৎকে শোনাব।’ স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে সে কথা যে তিনি শুনিয়েছিলেন, গোটা বিশ্বই তার সাক্ষী থেকেছে। একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, কেন ঠাকুরের এই কথাখানা সেদিন এতখানি আন্দোলিত করেছিল নরেন্দ্রনাথকে।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৯): মানুষ বড় কাঁদছে, মথুরবাবুকে বলে তাঁদের অন্নের ব্যবস্থা করলেন ঠাকুর
জীবে প্রেম বা জীবের প্রতি করুণা করার কথা আগেও অনেক মহাপুরুষ বলে গিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে এমরা শ্রীচৈতন্যের কথা স্মরণ করতে পারি। তিনিও সর্বজীবে দয়ার কথা প্রচার করেছিলেন। প্রকৃত ভক্তের হৃদয়ে এই ভাব জেগে উঠলে তবেই তিনি অধ্যাত্ম সাধনার পথে এগিয়ে যাবেন। করুণাঘন বুদ্ধও সেই একই কথা বলে গিয়েছেন। এমনকী যদি খ্রিস্টধর্মের দিকে তাকানো যায়, তাহলেও আমরা দেখব, সেখানেও অন্যের দুঃখকষ্টকে নিজের মতো মনে করে অনুভব করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সমস্ত ধর্মীয় আন্দোলনের মূলেই এই জীবের প্রতি প্রেমের কথাটি থেকে গিয়েছে। তাহলে ঠাকুর আলাদা কী বললেন, যাতে নরেন্দ্রনাথ বিস্মিত হলেন?
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৮): মাতৃতর্পণের সময় ঠাকুরের সঙ্গে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা
আসলে এইখানেও ঠাকুর তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে বেশ আলাদা। এর আগে যাঁরা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের প্রতি প্রেমের কথা বলেছেন, তাঁরা অধ্যাত্মসাধনার পূর্ণাঙ্গ প্রক্রিয়ার একটা অংশ হিসাবেই সেটিকে দেখেছেন। অর্থাৎ এই কাজের নৈতিক গুরুত্বকে স্বীকার করা হয়েছে সব ক্ষেত্রেই। কিন্তু ঠাকুর যে ঈশ্বরসাধনার প্রবর্তন করলেন তা একেবারে নতুন। সেখানে এই জীবসেবা বা সব জীবকে এক ঈশ্বরস্বরূপ দেখাকে আর ঈশ্বরসাধনার অংশ হিসাবে দেখা হচ্ছে না, বরং সেটিই হয়ে উঠছে সাধনার পূর্ণাঙ্গ রূপ। ঈশ্বরকে উপলব্ধির জন্য যেতে হবে মানুষের কাছে। এই হল ঠাকুরের স্পষ্ট কথা। বোঝাই যাচ্ছে, ধর্মসাধনার ভাণ্ডারে একটা নতুন ভাবনা এনে রাখলেন ঠাকুর। তাঁর এই ভাবনা সেই সময়ে দাঁড়িয়ে যে শুধু নতুন তা নয়, তা গোটা দেশকেই আমূল বদলে দিতে পেরেছিল। সেই বদলের কাণ্ডারি ছিলেন নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর যদি ভাবনাবিশ্ব হন, তবে নরেন্দ্রনাথ তাঁর বাস্তব রূপায়ণ। আমরা ঠাকুর নরেন্দ্রনাথের সম্পর্কের একেবারের গোড়ার দিকের কথা যদি স্মরণ করি তো দেখব, ঠাকুর এ পৃথিবীতে আসার সমইয় সপ্ত ঋষির এক ঋষির ধ্যান ভাঙিয়ে বলে এসেছিলেন তাঁর আসার কথা। দুজনে মিলে তাঁরা জগতের কাজ করবেন, এই যেন ছিল অলিখিত চুক্তি। ঠাকুর এখানে এসে অনেক খুঁজেছেন নরেন্দ্রনাথকে। যখন দেখা পেলেন তাঁর, তখন বহু পরীক্ষা করে তবে নিশ্চিত হয়েছেন। নরেন্দ্রনাথের অন্তরের দ্বিধাদ্বন্দ্বের নিরসন ঘটিয়েছেন। তারপর তাঁকে দিয়েছেন মহামন্ত্র। তাঁর ভাবনাকে যিনি বাস্তবায়িত করবেন, তিনিই সেদিন এই কথার তাৎপর্য বুঝেছিলেন। ধর্মসাধনার এই নতুন পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে গোটা দেশের চৈতন্যেই কীভাবে বদল এনেছিলেন নরেন্দ্রনাথ, পরবর্তী পর্বে এমরা শুনব সেই কথা।।