শোককাতর যুধিষ্ঠির যখন সব ছেড়ে বনে যাবেন বলে মনস্থ করেছেন, তখন কৃষ্ণ তাকে শান্ত করে বলেছেন, কামনা ও অহংকার বর্জনই হল প্রধান কথা। বিষয় ত্যাগে কামনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। তাই অনাসক্ত ভাবে রাজধর্ম পালন করো। সাত্ত্বিক যজ্ঞ, দান, তপস্যার দ্বারা, চিত্তশুদ্ধিকর কর্মের দ্বারা কামনা ত্যাগের চেষ্টা করো। এই ত্যাগই হল যজ্ঞের আসল কথা।
প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে যজ্ঞের প্রচলন আছে। এই যজ্ঞ অবশ্যই ফলপ্রদ। অর্থাৎ যজ্ঞ করে কিছু না কিছু ফল লাভ করা যায়। তার থেকেই একটা ধারণা গড়ে ওঠে যে, কিছু ফলের জন্যই বুঝি যজ্ঞ করতে হয়। ধর্মাচরণ সম্পর্কেও অনেকের সেই ধারণা। কিন্তু যজ্ঞ, দান, তপস্যা – এই সকল কর্ম চিত্তশুদ্ধিকর। অবশ্যকর্তব্য। তবে ফলের কামনা করেই তা করতে হয়। শ্রীগীতা আমাদের এই শিক্ষাই দেয়।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৯): নরেন্দ্রনাথের জন্য হাসিমুখে লাঞ্ছনাও ভোগ করেছিলেন ঠাকুর
মহামতী যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করেছিলেন। করেছিলেন শ্রী কৃষ্ণের পরামর্শেই। ফলত প্রশ্ন ওঠে, তাঁর যে এই যজ্ঞ, সে-ও কি ফলকামনায় নয়! এদিকে যুধিষ্ঠির নিজে তাঁর ভাবনা যখন জানাচ্ছেন তখন বলছেন, – ফল চেয়ে আমি কোনও কাজে প্রবৃত্ত হই না। দান করতে হয় তা-ই করি। যজ্ঞ করতে হয়, তা-ই করি। ধর্মাচরণের বিনিময়ে যে ফল চায় সে ধর্মবণিক। ধর্মকে সে পণ্যদ্রব্য করেছে। সে হীন, জঘন্য। এই যদি যুধিষ্ঠিরের ভাবনা, তাহলে তিনি রাজসূয় যজ্ঞ করলেন কেন? আবার, তাও সম্ভব হল কৃষ্ণের অনুমোদনেই। জ্ঞানীজনরা বলছেন, এর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। যুধিষ্ঠির এই যজ্ঞ করেছিলেন কর্তব্যের অনুরোধেই, নিষ্কামভাবে। এই যজ্ঞের লক্ষ্য ছিল, জরাসন্ধ, শিশুপালের মতো অত্যাচারী ধর্মদ্বেষী রাজাকে পরাজিত করে অখণ্ড ধর্মরাজ্যের প্রতিষ্ঠা। জরাসন্ধ নিজে একশোজন রাজাকে বলি দিয়ে একটি রাজমেধ যজ্ঞের আয়োজন করছিলেন। ছিয়াশি জন রাজা তাঁর কাছে পরাজিত হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছিলেন। সংখ্যা একশো হলেই এই পাশবিক কাণ্ড সম্পন্ন হত। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ আয়োজনে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। আবার যুদ্ধ শেষে যুধিষ্ঠির যে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন তা কৃষ্ণের আদেশেই।
আরও শুনুন- শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৭): ঠাকুরকে গুরু হিসাবে মেনে নিতে সম্মত হলেন নরেন্দ্রনাথ
শোককাতর যুধিষ্ঠির যখন সব ছেড়ে বনে যাবেন বলে মনস্থ করেছেন, তখন কৃষ্ণ তাকে শান্ত করে বলেছেন, কামনা ও অহংকার বর্জনই হল প্রধান কথা। বিষয় ত্যাগে কামনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। তাই অনাসক্ত ভাবে রাজধর্ম পালন করো। সাত্ত্বিক যজ্ঞ, দান, তপস্যার দ্বারা, চিত্তশুদ্ধিকর কর্মের দ্বারা কামনা ত্যাগের চেষ্টা করো। এই ত্যাগই হল যজ্ঞের আসল কথা। ত্যাগ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা স্বর্ণনকুলের কাহিনিতেও বর্ণিত। এই নকুলের অর্ধেক ছিল সোনার বরণ। বাকি দেহ সোনার বর্ণ করার জন্য সে অনেক যজ্ঞভূমিতে গড়াগড়ি দিয়েছে। কিন্তু ফল মেলেনি। যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের ভূমিতে সে যখন গড়াগড়ি দিচ্ছে, তখন তার কারণ জিজ্ঞাসা করা হল। নকুল বলল, একবার এক ব্রাহ্মণ নিজেদের সমস্ত খাবার অতিথিকে দিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে তিনি এবং তাঁর পরিবার উপবাসী থাকলেন। অতিথির ভোজনপাত্রে সামান্য যে কণাপরিমাণ খাবার লেগে ছিল, তারই উপর গড়াগড়ি দিয়েছিল নকুল। আর তাতেই তার দেহের অর্ধেক সোনার বরণ হয়েছে। বাকি আর কোথাও তেমন ত্যাগের মহিমা নেই, যা তার দেহকে স্বর্ণবর্ণ করতে পারে।
এইভাবেই ত্যাগকে আমাদের সংস্কৃতিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ত্যাগই প্রকৃত যজ্ঞ।