সব মত থেকেই একটা পথ পাওয়া যায়। সেই পথ ধরে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোও যায়। তার মানে এই নয় যে, মতটাই ঈশ্বর। নানা মতের মানুষের মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগেই থাকে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একে বলেন মতুয়ার বুদ্ধি অর্থাৎ কিনা গোঁড়ামি। আর তাঁর ভক্তদের মধ্যে যাতে গোঁড়ামি না থাকে সে ব্যাপারে সজাগ ছিলেন ঠাকুর। এ প্রসঙ্গে কী বলতেন তিনি ভক্তদের? আসুন শুনে নিই।
ব্রাহ্মসমাজে নাকি একবার সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছিল। যার ফলে অন্য মতের মানুষের সেখানে যাওয়ার জো ছিল না। একদিন সেই নিয়েই কথা বলতে শুরু করলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। বললেন,
শুনলাম, এখানে নাকি সাইনবোর্ড আছে। অন্য মতের লোক নাকি এখানে আসবার জো নাই! নরেন্দ্র বললে, সমাজে গিয়ে কাজ নাই, শিবনাথের বাড়িতে যেও।
আরও শুনুন: কেন নৃসিংহ অবতার ধারণ করেছিলেন ভগবান বিষ্ণু?
কিন্তু কেন একথা ঠাকুর তুললেন? কারণ সেদিন তিনি তাঁর ভক্তদের সামনে খুলে দিতে চাইছিলেন এক উন্মুক্ত পরিসর। যে জ্ঞান লাভ করলে বোঝা যায়, মত বা পথই শ্রেষ্ঠ নয়। সেই মত অবলম্বন করে ঈশ্বরলাভই মানুষের কাঙ্ক্ষিত। ঠাকুর তাই বলছেন, “আমি বলি সকলেই তাঁকে ডাকছে। দ্বেষাদ্বেষীর দরকার নাই। কেউ বলছে সাকার, কেউ বলছে নিরাকার। আমি বলি, যার সাকারে বিশ্বাস, সে সাকারই চিন্তা করুক। যার নিরাকারে বিশ্বাস, সে নিরাকারেই চিন্তা করুক। তবে এই লা যে, মতুয়ার বুদ্ধি (Dogmatism) ভাল নয়, অর্থাৎ আমার ধর্ম ঠিক আর সকলের ভুল। আমার ধর্ম ঠিক; আর ওদের ধর্ম ঠিক কি ভুল, সত্য কি মিথ্যা; এ আমি বুঝতে পাচ্ছিনে — এ-সব ভাল। কেননা ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার না করলে তাঁর স্বরূপ বুঝা যায় না। কবীর বলত, ‘সাকার আমার মা, নিরাকার আমার বাপ। কাকো নিন্দো, কাকো বন্দো, দোনো পাল্লা ভারী। হিন্দু, মুসলামান, খ্রীষ্টান, শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব, ঋষিদের কালের ব্রহ্মজ্ঞানী ও ইদানীং ব্রহ্মজ্ঞানী তোমরা — সকলেই এক বস্তুকে চাহিছ। তবে যার যা পেটে সয়, মা সেইরূপ ব্যবস্থা করেছেন। মা যদি বাড়িতে মাছ আনেন, আর পাঁচটি ছেলে থাকে, সকলকেই পোলাও কালিয়া করে দেন না। সকলের পেট সমান নয়। কারু জন্য মাছের ঝোলের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু মা সকলকেই সমান ভালবাসেন।
আরও শুনুন: পরহিতে আত্মত্যাগের মহৎ শিক্ষা দেয় মহর্ষি দধীচির উপাখ্যান
ঠাকুর এবার নিজেরই উদাহরণ দিয়ে একথাটাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, “আমার ভাব কি জানো? আমি মাছ সবরকম খেতে ভালবাসি। আমার মেয়েলি স্বভাব! (সকলের হাস্য) আমি মাছ ভাজা, হলুদ দিয়ে মাছ, টকের মাছ, বাটি-চচ্চড়ি — এ-সব তাতেই আছি। আবার মুড়িঘন্টোতেও আছে, কালিয়া পোলোয়াতেও আছি।” শুনে সকলেই হাসলেন। ঠাকুর বললেন, “কী জানো? দেশ-কাল-পাত্র ভেদে ঈশ্বর নানা ধর্ম করেছেন। কিন্তু সব মতই পথ, মত কিছু ঈশ্বর নয়। তবে আন্তরিক ভক্তি করে একটা মত আশ্রয় কল্লে তাঁর কাছে পোঁছানো যায়। যদি কোন মত আশ্রয় করে তাতে ভুল থাকে আন্তরিক হলে তিনি সে ভুল শুধরিয়ে দেন। যদি কেউ আন্তরিক জগন্নাথদর্শনে বেরোয়, আর ভুলে দক্ষিণদিকে না গিয়ে উত্তরদিকে যায়, তাহলে অবশ্য পথে কেউ বলে দেয় ওহে, ওদিকে যেও না — দক্ষিণদিকে যাও। সে ব্যক্তি কখনও না কখনও জগন্নাথদর্শন করবে। তবে অন্যের মত ভুল হয়েছে, এ-কথা আমাদের দরকার নাই। যাঁর জগৎ, তিনি ভাবছেন। আমাদের কর্তব্য, কিসে জো সো করে জগন্নাথদর্শন হয়। তা তোমাদের মতটি বেশ তো। তাঁকে নিরাকার বলছ, এ তো বেশ। মিছরির রুটি সিধে করে খাও, আর আড় করে খাই, মিষ্টি লাগবে।”
বাকি অংশ শুনে নিন।