নরেন্দ্র মিথ্যে বলছে, বিশ্বাস করতেও মন চায় না। আবার মা-ও মিথ্যে জিনিস দেখাবেন না। এখন কাকে জিজ্ঞেস করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবেন তিনি? আর কারোর থেকে তো জানার উপায় নেই। অগত্যা চললেন সেই মায়ের কাছেই। মাকেই বললেন, এর মীমাংসা করে দিতে। এই দোটানায় তিনি আর থাকতে চান না। জগদম্বা তখন বললেন, তুই নরেন্দ্রর কথা শুনিস কেন? কিছুদিন পরে ও সব সত্য বলে মানবে।
ঠাকুর যখন কেশব সেনের থেকেও উঁচু আসনে বসালেন তাঁকে, তখন যুবক নরেন্দ্রনাথ তো রেগেই গেলেন। প্রতিবাদ করলেন সে কথার। এদিকে ঠাকুর বলছেন, আমি কী করব! মা যা বলেছে, তাই তো বলছি। নরেন্দ্রনাথ শুনে বললেন, মা দেখিয়ে থাকেন নাকি আপনি মাথার খেয়ালে ওসব দেখেন! আমার যদি এরকম হতো, তো ঠিক বুঝতাম যে মাথার খেয়ালেই এরকম দেখতে পাচ্ছি। তারপর একটু শান্ত হয়ে বললেন, আপনি আমাকে স্নেহ করেন। সব বিষয়ে বড় করে দেখতে চান। তাই এরকম দর্শন হয় আপনার। এই শুনে ঠাকুর তো পড়লেন চিন্তায়। একদিকে তাঁর মনে হল, নরেন্দ্রনাথকে তো তিনি চিনেছেন। সে তো মিথ্যা কথা বলবে না। সে কায়মনোবাক্যে সত্যপরায়ণ। তা ছাড়া নরেন্দ্রনাথের মতো দৃঢ় সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তির মনে সত্য ভিন্ন মিথ্যা সঙ্কল্পের উদয় হবেই বা কেন! আবার মা জগদম্বা তাকে যা দেখিয়েছেন, যা বলেছেন- তাইই বা অস্বীকার করবেন কী করে!
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৮): নরেন্দ্রনাথের মনের দৃঢ়তা পরীক্ষা করে দেখেও নিতেন ঠাকুর
মহা সমস্যায় পড়লেন ঠাকুর। তাঁর মনে হতে লাগল, তবে কি তিনি ভুল দেখেছেন! তাঁর দর্শনে কোনও ভ্রম হয়েছে। আবার তিনি এ-ও পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, মা তাকে কোনও ভুল জিনিস কখনও দেখান না। সত্যনিষ্ঠা থাকলে জগদম্বা তাকে বেচালে পা পড়তে দেন না। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল এখন! নরেন্দ্র মিথ্যে বলছে, বিশ্বাস করতেও মন চায় না। আবার মা-ও মিথ্যে জিনিস দেখাবেন না। এখন কাকে জিজ্ঞেস করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবেন তিনি? আর কারোর থেকে তো জানার উপায় নেই। অগত্যা চললেন সেই মায়ের কাছেই। মাকেই বললেন, এর মীমাংসা করে দিতে। এই দোটানায় তিনি আর থাকতে চান না। জগদম্বা তখন বললেন, তুই নরেন্দ্রর কথা শুনিস কেন? কিছুদিন পরে ও সব সত্য বলে মানবে। মায়ের মুখ থেকে এই আশ্বাস পেয়ে তবে নিশ্চিন্ত হতেন ঠাকুর। আর নরেন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর ভালবাসা যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠত।
আরও শুনুন- শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৭): ঠাকুরকে গুরু হিসাবে মেনে নিতে সম্মত হলেন নরেন্দ্রনাথ
একদিন ঠাকুর, বুঝিবা নরেন্দ্রনাথের টানের ব্রাহ্মমন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানে উপস্থিত ভক্তেরা তাঁর কথা ইতিমধ্যে কেউ কেউ শুনেছিলেন। অনেকেই দেখেননি। ঠাকুর যাওয়ায় তাই সবার মধ্যেই একটা আলোড়ন পড়ে গেল। আচার্য তাঁর কাজ স্থগিত রাখলেন। নরেন্দ্রনাথ দেখলেন, উপস্থিত কেউই ঠাকুরকে সমাদর করে আহ্বান জানালেন না। বরং সকলের সেই ভিড়ের মধ্যে তিনি পড়ে গিয়েছেন একা। অনেক কষ্ট করে নরেন্দ্রনাথ সেদিন ঠাকুরকে বাইরে বের করে আনলেন। তারপর বকাঝকা করতে শুরু করলেন। কিন্তু ঠাকুর না সেই ঘটনায় ক্ষুণ্ণ হলেন। না নরেন্দ্রনাথের বকাবকিতে কান দিলেন। এদিকে নরেন্দ্রনাথ ভাবতে লাগলেন, শুধু তাকে দেখার জন্যই ঠাকুর তো সেখানে গিয়েছিলেন। আর গিয়ে অশেষ লাঞ্ছনা ভোগ করতে হল। যে মানুষ এমন করে ভালোবাসতে পারেন, তাকে কতই বা আর বকাঝকা করা যায়!
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৬): অখণ্ডের রাজ্যে যে ঋষিকে দেখেছিলেন ঠাকুর, তিনিই নরেন্দ্রনাথ
শাস্ত্রজ্ঞ নরেন্দ্রনাথ মজা করে বললেন, পুরাণে আছে ভরত রাজা হরিণ হরিণ বলতে বলতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মৃত্যুর পরে তাই হরিণ হয়েছিলেন। এই যদি সত্যি হয়, তাহলে ঠাকুর যেভাবে নরেন্দ্রনাথের কথা চিন্তা করছেন, তার পরিণাম কী দাঁড়াবে। ঠাকুর শুনে হেসে ওঠেন। বলে, তাই তো রে! সেও তো ভাববার কথা। কিন্তু কী করব! আমি যে তোকে না দেখে থাকতে পারি না। সেই কথাটাই বিমর্ষ ঠাকুর মা জগদম্বাকে জানাতে গেলেন। তারপর হাসতে হাসতে ফিরে এলেন। তারপর নরেন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যা শালা! আমি তোর কোনও কথা শুনব না। মা আমাকে বললেন, তুই নরেন্দ্রকে সাক্ষাৎ নারায়ণ বলে জানিস, তাই ভালবাসিস, যেদিন ওর ভিতর নারায়ণকে না দেখতে পাবি, সেদিন ওর মুখ দেখতেও পারবি না।’
নরেন্দ্রনাথের ভিতর সাক্ষাৎ নারায়ণকেই দেখেছিলেন ঠাকুর।