ঠাকুর কেশব, বিজকৃষ্ণকে দেখলেন ভাল করে। তারপর নরেন্দ্রনাথকেও নিরীক্ষণ করলেন। সভাশেষে বললেন, “দেখলাম, কেশব যেমন একটা শক্তির বিশেষ উৎকর্ষে জগদ্বিখ্যাত হয়েছে, নরেন্দ্রের ভিতর ওই রকম আঠারটা শক্তি পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান! আবার দেখলাম, কেশব ও বিজয়ের অন্তর দীপশিখার ন্যায় জ্ঞানালোকে উজ্জ্বল রয়েছে; পরে নরেন্দ্রের দিকে চেয়ে দেখি, তার ভিতরের জ্ঞান-সূর্য উদিত হয়ে মায়া-মোহের লেশটুকুও দূর করেছে!”
নরেন্দ্রনাথ আর ঠাকুরের মধ্যে সম্পর্ক এখন খানিক সহজ হয়েছে। প্রথম দেখায় যাঁকে উন্মাদ মনে হয়েছিল, সেই ঠাকুরকেই এবার মনে মনে গুরু মেনে নিতে সম্মত নরেন্দ্রনাথ। তবে তাঁর সব কথা যে তিনি মেনে নেবেন তেমনটি হওয়ার জো নেই। নরেন্দ্রনাথ সেরকম মানুষই নন। ঠাকুর তো নরেন্দ্রনাথকে চিনেও নিয়েছেন, বুঝেও নিয়েছেন। এদিকে নরেন্দ্রনাথের মনের মধ্যে চলছে তোলপাড়। তিনি বুঝতে পারছেন, ঠাকুর প্রথমদিন তাঁকে যা যা বলেছিলেন, তা যদি বিশ্বাস করতে হয়, তবে স্বীকার করতে হবে যে ঠাকুর অবতার। সেই বিশ্বাসের বিন্দুতে ক্রমশ পৌঁছাচ্ছেন নরেন্দ্রনাথ। তবে এই যে নিজের পুরনো ধারণা ভেঙে নতুন ধারণার দিকে এগোচ্ছেন, তাতেই মনের মধ্যে চলছে ব্যাপক আলোড়ন। তবে নরেন্দ্রনাথ ঠিক করেই নিয়েছেন যে, ঠাকুরের কথা ভালো করে বুঝে, বিচার করে তবেই বিশ্বাস করবেন।
আরও শুনুন- শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৭): ঠাকুরকে গুরু হিসাবে মেনে নিতে সম্মত হলেন নরেন্দ্রনাথ
এদিকে নরেন্দ্রনাথকে পেয়ে ঠাকুরের তো আনন্দের শেষ নেই। নরেন্দ্রনাথকে দেখতে না পেলে তিনি ভারি অধৈর্য হয়ে পড়েন। সকলের কাছে খোঁজ নিতে থাকেন। ঠাকুরের এই যে ভাব, শাস্ত্রে একে বলে শাম্ভবী দীক্ষা। সুযোগ্য শিষ্যের দেখা পেলে গুরুর প্রাণ এমন আকুলি-বিকুলি করতে থাকে। মনে হতে থাকে, নিজের যা কিছু অভিজ্ঞতা, যা কিছু অর্জন- সবই শিষ্যের হাতে তুলে দিই। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণেরও এখন সেই অবস্থা। এ নেহাত সাংসারিক ভাব-ভালোবাসা নয়। সংসারেও তো মানুষ একে অন্যকে ভালোবাসে, হৃদয়ের সবটুকু অন্যকে সমর্পণ করে। সেখানে প্রিয়জনের অদর্শনে প্রাণ আনচান করে। কিন্তু নরেন্দ্রনাথের সম্পর্কে ঠাকুরের যে প্রেম, তাতে সংসারের নামগন্ধ ছিল না। এ যেন ঐশ্বরিক, অলৌকিক, স্বার্থগন্ধহীন এক অপ্রাকৃত লীলা। উপস্থিত সকলেই বুঝতে পারছিলেন এক অন্য প্রেমের সাক্ষী থাকছেন তাঁরা। সে প্রেম উচ্চ আধ্যাত্মিক প্রেম।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৬): অখণ্ডের রাজ্যে যে ঋষিকে দেখেছিলেন ঠাকুর, তিনিই নরেন্দ্রনাথ
আর নরেন্দ্রনাথকে অমন করে ভাল না বেসে ঠাকুরই বা থাকেন কী করে! তিনি তো জানেন, নরেন্দ্রনাথ অপরিসীম শক্তির অধিকারী। একদিন তো বলেই ফেললেন সে কথা। সেদিন ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন কেশবচন্দ্র সেন, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মতো বিখ্যাত মানুষ। সেখানে যুবক নরেন্দ্রনাথও উপস্থিত ছিলেন। ঠাকুর কেশব, বিজকৃষ্ণকে দেখলেন ভাল করে। তারপর নরেন্দ্রনাথকেও নিরীক্ষণ করলেন। সভাশেষে বললেন, “দেখলাম, কেশব যেমন একটা শক্তির বিশেষ উৎকর্ষে জগদ্বিখ্যাত হয়েছে, নরেন্দ্রের ভিতর ওই রকম আঠারটা শক্তি পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান! আবার দেখলাম, কেশব ও বিজয়ের অন্তর দীপশিখার ন্যায় জ্ঞানালোকে উজ্জ্বল রয়েছে; পরে নরেন্দ্রের দিকে চেয়ে দেখি, তার ভিতরের জ্ঞান-সূর্য উদিত হয়ে মায়া-মোহের লেশটুকুও দূর করেছে!”
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৫): ঠাকুরের স্পর্শে আবার বাহ্যজ্ঞান লোপ হল নরেন্দ্রনাথের
ঠাকুরের মুখে এই কথা শুনলে আর পাঁচজনে খুশিই হতেন। আনন্দে পূর্ণ হত অন্তর। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ যে অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। এ কথা শুনে তিনি রেগেই গেলেন। বললেন, কোথায় জগদ্বিখ্যাত কেশব সেন, বিজয়কৃষ্ণ… আর কোথায় সামান্য একটা স্কুলের ছোঁড়া! প্রতিবাদ করে নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বরং বলে দিলেন, এমন তুলনা করলে তো লোকে আপনাকে উন্মাদ বলবে! নরেন্দ্রনাথের সেই কথা শুনে ঠাকুর বললেন, ‘কি করব রে, তুই কি ভাবিস আমি অমন বলেছি, মা জগদম্বা আমাকে যা দেখালেন, তাই বলেছি; মা তো আমাকে সত্য ভিন্ন মিথ্যা কখনও দেখান নাই, তাই বলেছি।”
আরও শুনুন- শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৪): ঠাকুর যেন এক রহস্যের খনি, বিস্ময়ে অনুভব করলেন নরেন্দ্রনাথ
আসলে নরেন্দ্রনাথের প্রতিবাদ শুনে মনে মনে সন্তুষ্টই হয়েছিলেন ঠাকুর। এই যে তিনি সবার সামনে নরেন্দ্রনাথের খুব করে প্রশংসা করতেন, তা ছিল একরকম পরীক্ষা। নিজের প্রশংসা শুনলে দুর্বল মনে জেগে ওঠে অহঙ্কার। কিন্তু নরেন্দ্রনাথের মতো দৃঢ়শক্তির মনের মানুষের এমন হওয়ার কথা নয়। সেটাই পরীক্ষা করে দেখে নিতেন ঠাকুর। নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথার প্রতিবাদ করে যত তর্ক করতেন, ঠাকুর তত বুঝতেন, শিষ্য চিনতে তিনি মোটেও ভুল করেননি।