কল্পতরু হয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কৃপা করেছিলেন তাঁর ভক্তদের। তিনি যে যুগাবতার সেই রূপ প্রকাশ করেছিলেন সকলের সামনে। তবে তিনি যে অবতার সে কথা তিনি হয়তো আগেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। অবতার না হলে ভক্ত গিরিশের বকলমা তিনি নেবেন কেন? আসুন আমরা আজ শুনে নিই ঠাকুরের লীলার আর এক কাহিনি।
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন,
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্ যাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োবসি মে
অর্থাৎ তুমি আমার ভক্ত হও। আমার পূজা করো, আমাতে চিত্ত অর্পণ কর। তাহলেই তুমি আমাকে পাবে। প্রায় একইরকম কথা বলেছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। বলেছিলেন তাঁর পরম ভক্ত নট ও নাট্যকার গিরিশ ঘোষকে। ঠাকুর তাঁর বকলমা নিয়েছিলেন। কেন নিয়েছিলেন, তা জানতে আমাদের একটু বিশদে তাঁদের কথোপকথন লক্ষ্য করতে হবে।
আরও শুনুন: কেন কল্পতরু হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ?
গিরিশ যখন ঠাকুরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছেন, তখন একদিন জানতে চাইলেন, আমি এরপর কী করব? ঠাকুর বললেন, “যা করচ তাই করে যাও। এখন এদিক (ভগবান) ওদিক (সংসার) দুদিক রেখে চল, তারপর যখন একদিক ভাঙবে তখন যা হয় হবে। তবে সকালে-বিকালে তাঁর স্মরণ-মননটা রেখো।” বলে ঠাকুর গিরিশের মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন। গিরিশ এর জবাবে কী বলবেন, তারই অপেক্ষা করে আছেন। এদিক গিরিশ কোনও কথাই বলছেন না। ঠাকুরের কথা শুনে তিনি খানিক বিষণ্ণ। মনে মনে ভাবছেন, আমার যে কাজ তাহাতে স্নান-আহার-নিদ্রা প্রভৃতি নিত্যকর্মেরই একটা নিয়মিত সময় রাখিতে পারি না। সকালে-বিকালে স্মরণ-মনন করিতে নিশ্চয়ই ভুলিয়া যাইব। তাহা হইলে তো মুশকিল – শ্রীগুরুর আজ্ঞালঙ্ঘনে মহা দোষ ও অনিষ্ট হইবে। অতএব এ কথা কি করিয়া স্বীকার করি? সংসারে অন্য কাহারও কাছে কথা দিয়াই সে কথা না রাখিতে পারিলে দোষ হয়, তা যাঁহাকে পরকালের নেতা বলিয়া গ্রহণ করিতেছি তাঁহার কাছে – !’ কিন্তু কুণ্ঠার কারণে এ কথাগুলি ঠাকুরকে বলতেও পারছেন না। আরও ভাবছেন যে, কিন্তু ঠাকুর আমাকে তো আর কোন একটা বিশেষ কঠিন কাজ করিতে বলেন নাই। অপরকে এ কথা বলিলে এখনি আনন্দের সহিত স্বীকার পাইত। কিন্তু তিনি তো নিজেকে চেনেন। তাই প্রতিদিনের এই ধর্মকর্ম সংক্রান্ত কাজকর্ম যে তাঁর দ্বারা হবে না, সে তিনি ভালই বুঝতে পারছিলেন। তাই কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকলেন। এদিকে ঠাকুর গিরিশের মনের কথা ঠিক বুঝতে পারলেন। তখপ্ন গিরিশকে তিনি বললেন, আচ্ছা, তা যদি না পার তো খাবার শোবার আগে তাঁহার একবার স্মরণ করে নিও।”
আরও শুনুন: পৃথিবীতে কে আমাদের কাছের মানুষ? উত্তর দিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ
গিরিশ দেখলেন এ-ও মহা বিপদের। কোনদিন খান বেলা দশটায় তো কোনদিন পাঁচটায়। আর মামলা-মোকদ্দমায় ব্যস্ত হয়ে গেলে তো আর কথাই নেই। সারাদিন হয়তো খাওয়ার হুঁশই থাকল না। তাহলে স্মরণ হবে কী করে? গিরিশ মনে মনে আবার ভাবছেন, ঠাকুর এত সোজা একটা কাজ করতে বললেন, তাও তিনি করে উঠতে পারছেন না। ঠাকুর এবারও গিরিশের মনের কথা বুঝলেন। তখন হাসতে হাসতে বললেন, আচ্ছা, তবে আমায় বকলমা দে। বলেই ঠাকুর সমাধিস্থ হলেন, তাঁর তখন অর্ধবাহ্যদশা! ঠাকুরের এই কথা শুনে গিরিশের প্রাণ জুড়োল। তিনি মনে মনে ভাবলেন, ‘যাক্ – নিয়মবন্ধনগুলিকে বাঘ মনে হয়, তাহার ভিতর আর পড়িতে হইল না। এখন যাহাই করি না কেন এইটি মনে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করিলেই হইল যে, ঠাকুর তাঁহার অসীম দিব্যশক্তিবলে কোন-না-কোন উপায়ে তাঁহাকে উদ্ধার করিবেন।’ বকলমা দেওয়ার এটুকুই অর্থ বুঝেছিলেন সেদিন গিরিশ।
অনেক পরে যেন ঠাকুরের এই কথার গূঢ় কথার অর্থ বোধ করলেন গিরিশ। তখন ঠাকুর অদর্শন হয়েছেন। পারিবারিক কারণে গিরিশও নানা কারণে বিভ্রান্ত। ঠিক সেই সময় তখন প্রতি পদক্ষেপেই মনে হত, ‘তিনি (শ্রীরামকৃষ্ণদেব) ঐরূপ হওয়া তোর পক্ষে মঙ্গলকর বলিয়াই ঐসকল হইতে দিয়াছেন। তুই তাঁহার উপর ভার দিয়াছিস, তিনিও লইয়াছেন; কিন্তু কোন্ পথ দিয়া তিনি তোকে লইয়া যাইবেন, তাহা তো আর তোকে লেখাপড়া করিয়া বলেন নাই? তিনি এই পথই তোর পক্ষে সহজ বুঝিয়া লইয়া যাইতেছেন, তাহাতে তোর ‘না’ বলিবার বা বিরক্ত হইবার তো কথা নাই। তবে কি তাঁহার উপর বকলমা বা ভার দেওয়াটা একটা মুখের কথামাত্র বলিয়াছিলি?’ সেদিন কি গিরিশ বকলমা দেওয়ার গূঢ় অর্থ বুঝেছিলেন? হ্যাঁ, তখনই তিনি অনুধাবন করেছিলেন, সাধন-ভজন-জপ-তপরূপ কাজের একটা সময়ে অন্ত আছে, কিন্তু যে বকলমা দিয়েছে তার কাজের আর অন্ত নাই – তাকে প্রতি পদে, প্রতি নিঃশ্বাসে দেখতে হয় তাঁর (ভগবানের) উপর ভার রেখে তাঁর জোরে পা-টি, নিঃশ্বাসটি ফেললে, না এই হতচ্ছাড়া ‘আমি’-টার জোরে সেটি করলে!”
আরও শুনুন: কোন কোন মানুষের থেকে সাবধানে থাকতে হয়? উপদেশ দিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ
একমাত্র অবতারই তো এই বকলমা নিতে পারেন। মানুষের পক্ষে মানুষের ভার নেওয়া সম্ভব নয়। এবার একেবারে যদি গোড়ার কথাটিতে ফিরে যাই, তাহলে দেখব শ্রীকৃষ্ণও গীতাতে সেই কথাটিই বলছেন। তাঁর প্রতি চিত্ত সমর্পণ, তাঁর চিন্তা করার অর্থ অনুক্ষণ তাঁর ধ্যানে মগ্ন থাকতে হবে তা নয়। কিন্তু এমনভাবেই যাতে জীবনের কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে শ্রীকৃষ্ণ থেকে মন না সরে। গিরিশের বকলমা দেওয়ায় ঠিক তাই-ই হয়েছিল। জপ-তপের তবু শেষ আছে। কিন্তু বকলমা দেওয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঠাকুরকে স্মরণ করেই তাঁর পথচলা নির্ধারিত হয়েছিল। অবতারগণ এভাবেই মানবকে পৌঁছে দেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে, শুদ্ধাভক্তিতে।