ঠাকুর দেখছেন, সেই দেব-শিশু একজন ঋষির কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। তাঁর কোমল হাত দুটি দিয়ে জড়িয়ে ধরল সেই ঋষির গলা। তারপর ঋষির সমাধি ভাঙার চেষ্টা করতে লাগল। বালকের কণ্ঠস্বর শুনে সমাধির কোন স্তর থেকে যেন নেমে এলেন ঋষিপ্রবর। অর্ধস্তিমিত নয়নে সেই বালককে দেখতে লাগলেন। তাঁর মুখে ফুটে উঠল প্রসন্ন আলো। যেন তাঁরা একে অন্যকে বহুকাল থেকে চেনেন।
দক্ষিণেশ্বরে এই নিয়ে মোটে বার তিনেকের দেখা গুরু-শিষ্যে। তার মধ্যে দুবারই ঘোর লাগিয়ে নরেন্দ্রনাথের ভাবান্তর ঘটিয়েছিলেন ঠাকুর। দ্বিতীয়বার যখন নরেন্দ্রনাথের বাহ্যজ্ঞান লোপ পেয়েছে, তখন অনেক কিছু প্রশ্নও করেছিলেন ঠাকুর। সেই বিশেষ অবস্থাতেই তার জবাবও দিয়েছিলেন যুবক নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর পরে বলেছিলেন, যা শুনেছিলেন সে সব বিশদে বলতে নিষেধ আছে। তবে এ কথা ঠিক, ঠাকুর কিছু একটা যেন মিলিয়ে নিচ্ছিলেন। বলেওছিলেন সে কথা। আগে যা দেখেছিলেন, তাই-ই প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথের থেকে। অর্থাৎ, যিনি নরেন্দ্রনাথের রূপ ধরে এসেছেন, তাঁর সঙ্গে ঠাকুরের আগেও দেখা হয়েছিল। তিনিই এসেছেন কিনা, সেটিই মিলিয়ে নিচ্ছিলেন ঠাকুর।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৫): ঠাকুরের স্পর্শে আবার বাহ্যজ্ঞান লোপ হল নরেন্দ্রনাথের
অর্থাৎ নরেন্দ্রনাথ আসার আগেই তাঁর আসার কথা জানতেন তিনি। বলতেনও তো, আমি তাঁর অপেক্ষা করে বসে থাকি। সে কি কেবল কথার কথা! ঠাকুরকে যে তিনি কথা দিয়েছিলেন যে, তিনি আসবেন। সেই যে পূর্বদর্শন, সে অভিজ্ঞতার কথাও ঠাকুর বলেছিএন পরে। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। ঠাকুর তখন সমাধিস্থ। মন ক্রমশ জ্যোতির্ময় ক্ষেত্রে আরোহণ করছে। ঠাকুর দেখছেন, তিনি পেরিয়ে যাচ্ছে চন্দ্র-সূর্যের স্থূলময় জগত। তারপর ক্রমশ প্রবেশ করছেন সূক্ষ্ম ভাবজগতে। সেই রাজ্য ধরে একটু একটু এগিয়ে চলেছেন ঠাকুর। দেখছেন পথের দুধারে দেবদেবীদের ভাবঘন মূর্তি। ঠাকুর এগোচ্ছেন তো এগোচ্ছেন।
আরও শুনুন- শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৪): ঠাকুর যেন এক রহস্যের খনি, বিস্ময়ে অনুভব করলেন নরেন্দ্রনাথ
এগোতে এগতে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে দেখলেন সেই রাজ্যের চরম সীমায় যেন একখানি বেড়া দেওয়া আছে। জ্যোতির্ময় সেই ব্যবধান। তার এদিকে খণ্ড, অন্যদিকে অখণ্ডের সংসার। ঠাকুরের মন এবার সেই ব্যবধান অতিক্রম করে প্রবেশ করল নতুন রাজ্যে। ঠাকুর আবিষ্কার করলেন এ যেন এক আশ্চর্য জগৎ। ঠাকুর দেখছেন, এ এমন রাজ্যে যেখানে দেবদেবীরাও প্রবেশ করতে পারেন না। তাঁরা অনেকটা নিচে নিজেদের অধিকার বিস্তৃত করে আছেন। তাহলে অখণ্ডের রাজ্যে আছেনটা কে? কৌতূহলে এগিয়ে যাচ্ছে ঠাকুরের মন। আর সন্ধান পাচ্ছে এক অপূর্ব দৃশ্যের। দেখলেন, দিব্যজ্যোতি ঘনতনু সাতজন ঋষি সেখানে আছেন। প্রেমে-পুণ্যে-ত্যাগে তাঁরা এতটাই উচ্চ মার্গে অবস্থান করছেন যে, দেবদেবী সকলকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন। বিস্মিত ঠাকুর। এই ঋষিদের মহত্ত্বের কথা চিন্তা করছেন। এমন সময় সেই জ্যোতির্মণ্ডলের একটা অংশ ঘনীভূত হয়ে একজন দিব্যশিশুর রূপ নিল।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৩): ঠাকুর পা তুলে দিলেন কোলে, নরেন্দ্রনাথের সামনে দুলে উঠল গোটা বিশ্ব
ঠাকুর দেখছেন, সেই দেব-শিশু একজন ঋষির কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। তাঁর কোমল হাত দুটি দিয়ে জড়িয়ে ধরল সেই ঋষির গলা। তারপর ঋষির সমাধি ভাঙার চেষ্টা করতে লাগল। বালকের কণ্ঠস্বর শুনে সমাধির কোন স্তর থেকে যেন নেমে এলেন ঋষিপ্রবর। অর্ধস্তিমিত নয়নে সেই বালককে দেখতে লাগলেন। তাঁর মুখে ফুটে উঠল প্রসন্ন আলো। যেন তাঁরা একে অন্যকে বহুকাল থেকে চেনেন। সেই অদ্ভুত দেব-শিশু তখন আনন্দে বলে উঠল, ‘আমি যাচ্ছি, তোমাকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে’। ঋষি শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুখে কিছু বললেন না। কিন্তু তাঁর দুই চোখে ফুটে উঠল সম্মতি। ঠাকুর দেখলেন, একটু পরেই ঋষির শরীর-মনের একাংশ জ্যোতির আকার ধারণ করে ধরাধামের প্রতি নেমে যাচ্ছে।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২): ঠাকুরের আচরণ দেখে নরেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন মানুষটা ‘অদ্ভুত পাগল’
এই হল সেই অভূতপূর্ব দর্শন অভিজ্ঞতা। যা ঠাকুরের হয়েছিল। নরেন্দ্রনাথকে যেদিন তিনি প্রথম দেখেন, সেদিনই চিনতে পেরেছিলেন। পরে তাঁকে প্রশ্ন করে জেনেও নিয়েছিলেন। তাই গোড়ার দিকের সাক্ষাতেই ঠাকুরের স্পর্শে জ্ঞান লোপ হয়েছিল নরেন্দ্রর। নরেন্দ্রর উত্তর পেয়ে ঠাকুরের আর কোনও সন্দেহই থাকল না যে, সেই অখণ্ডের রাজ্যেই ঋষিই নেমে এসেছেন নরেন্দ্রনাথ হয়ে।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১): তিনি নররূপী নারায়ণ, এসেছিলেন জীবের দুর্গতি নিবারণে
সে তো হল। তবু আর একটা প্রশ্ন যে থেকেই যায়। ভক্তেরা সেই প্রশ্ন করেন ঠাকুরকে। যে দর্শনের গল্প তিনি শোনালেন, সেখানে যে দেব-শিশুটিকে দেখা গেল তিনি কে? ঠাকুর স্মিত হেসে জানেন, সে শিশু তিনি স্বয়ং। আমাদের আর বুঝতে বাকি থাকে না, সেই অখণ্ডের সংসার থেকেই নিচে নেমে এসেছেন দুই মহৎ সাধক। এই দুজনেরই অপূর্ব লীলাপ্রসঙ্গের সাক্ষী থাকবে গোটা বিশ্ব।