কেনই বা নারীদের শুধুমাত্র ‘পুত্র-উৎপাদনের যন্ত্র’ হিসাবে দেখা শুরু হল, তা নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন বিবেকানন্দ। স্বামীজি বলছেন, “পরব্রহ্মতত্ত্বে লিঙ্গভেদ নাই। আমরা দেখিতে পাই। আমার মন যত অন্তর্মুখ হইতে থাকে, ততই ঐ ভেদজ্ঞান চলিয়া যায়। শেষে মন যখন সমরস ব্রহ্মতত্ত্বে ডুবিয়া যায়, তখন আর এ–স্ত্রী ও-পুরুষ—–এই জ্ঞান একেবারেই থাকে না।
মা সারদার প্রতি ঠাকুরের যে দিব্য সম্পর্ক, তা আসলে অনেকগুলো দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। কেন যে তিনি সংসারী হয়েও সন্ন্যাসী কিংবা সন্ন্যাসী হয়েও সংসারী, সেদিন যেন ভাল করে কেউ বুঝেই উঠতে পারেননি। তাঁরা দুজনেই দুজনের ভিতর মা কালীকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। স্বামী-স্ত্রী, নারী-পুরুষের এই যে সমভাব সেদিন ঠাকুর এনেছিলেন, মায়ের সহায়তাতেই, তা আদতে সামাজিক বিপ্লব।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৬): সংসার আর সন্ন্যাসকে আশ্চর্য সমন্বয়ে বেঁধেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ
ঠাকুরের নরেন্দ্রনাথ এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা করে পরে জানিয়েছিলেন এর মাহাত্ম্য। কেনই বা নারীদের শুধুমাত্র ‘পুত্র-উৎপাদনের যন্ত্র’ হিসাবে দেখা শুরু হল, তা নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন বিবেকানন্দ। ঠিক তখনই তিনি মনে করিয়ে দেন, নারীদের প্রতি তাঁর গুরুর দৃষ্টিভঙ্গি। স্বামীজি বলছেন, “পরব্রহ্মতত্ত্বে লিঙ্গভেদ নাই। আমরা দেখিতে পাই। আমার মন যত অন্তর্মুখ হইতে থাকে, ততই ঐ ভেদজ্ঞান চলিয়া যায়। শেষে মন যখন সমরস ব্রহ্মতত্ত্বে ডুবিয়া যায়, তখন আর এ–স্ত্রী ও-পুরুষ—–এই জ্ঞান একেবারেই থাকে না। আমরা শ্রীরামকৃষ্ণদেবে ঐরূপ প্রত্যক্ষ করিয়াছি। তাই বলি, মেয়ে-পুরুষে বাহ্য ভেদ থাকিলেও স্বরূপতঃ কোন ভেদ নাই। অতএব পুরুষ যদি ব্রহ্মজ্ঞ হইতে পারে, তবে স্ত্রীলোক তাহা হইতে পারিবে না কেন? যখন সর্বাবভাসাত্মক আত্মতত্ত্ব প্রত্যক্ষ করিবে, তখন দেখিবে এই স্ত্রী-পুরুষ-ভেদজ্ঞান একেবারে লুপ্ত হইবে। শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে দেখিয়াছি –স্ত্রীমাত্রেই মাতৃভাব – তা যে-জাতির যেরূপ স্ত্রীলোকই হউক না কেন।”
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৫): ঠাকুরকে ঈশ্বরের অবতার হিসাবে চিনেছিলেন ভৈরবী মা
এই ভাবনার আলোকেই মা সারদা আর ঠাকুরের দিব্য দাম্পত্যের ব্যাখ্যা করে তিনি বলছেন, “শ্রীরামকৃষ্ণের অলৌকিক হৃদয়োত্থিত অমানব ভাবের উপর একটি আক্ষেপ এই যে, তিনি সন্ন্যাসগ্রহণ করিয়া স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করিয়াছিলেন। তাহাতে অধ্যাপক মোক্ষমূলার উত্তর দিয়াছেন যে, তিনি স্ত্রীর অনুমতি লইয়াই সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন এবং যতদিন মর্তধামে ছিলেন, তাঁহার স্ত্রী তাহাকে গুরুভাবে গ্রহণ করিয়া স্বেচ্ছায় পরমানন্দে তাহার উপদেশ অনুসারে আকুমার ব্রহ্মচারিণীরূপে ভগবৎসেবায় নিযুক্তা ছিলেন। অধ্যাপক আরও বলেন যে, শরীর-সম্বন্ধ না থাকিলে কি বিবাহে এতই অসুখ ? তিনি বলেন, শরীর-সম্বন্ধ না রাখিয়া ব্রহ্মচারিণী পত্নীকে অমৃতস্বরূপ ব্রহ্মানন্দের ভাগিনী করিয়া ব্রহ্মাচারী পতি যে পরম পবিত্রভাবে জীবন অতিবাহিত করিতে পারেন, এ বিষয়ে উক্ত ব্রতধারী ইওরোপনিবাসীরা সফলকাম হয় নাই, আমরা মনে করিতে পারি; কিন্তু হিন্দুরা যে অনায়াসে ঐ প্রকার কামজিৎ অবস্থায় কালাতিপাত করিতে পারে, ইহা আমরা বিশ্বাস করি।” অধ্যাপকের মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক! আমাদের ব্রহ্মচর্য যে ধর্মলাভের একমাত্র উপায়, তিনি বিজাতি বিদেশী হইয়া তাহা বুঝিতে পারেন এবং ভারতবর্ষে যে ইহা এখনো বিরল নহে, বিশ্বাস করেন—আর আমাদের ঘরের মহাবীরেরা বিবাহে শরীর-সম্বন্ধ বই আর কিছুই দেখিতে পাইতেছেন না। ধর্ম পুরুষের পক্ষে যেমন, রমণীগণের পক্ষেও ব্রহ্মচর্যকে তেমনি উচ্চাসন দিয়া থাকেন। পূর্ণ যোগী হইতে গেলে, লিঙ্গাভিমান ত্যাগ করিতে হইবে। আত্মার কোন লিঙ্গ নাই। তবে তিনি লিঙ্গাভিমান দ্বারা আপনাকে কলুষিত করিবেন কেন ? আত্মাতে স্ত্রী পুংভেদারোপ ভ্রম মাত্র—–শরীর-সম্বন্ধেই উহা সত্য।”
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৪): ধ্যানের সময় ঠাকুরের শরীর থেকে বেরিয়ে গেল পাপপুরুষ
স্বামীজির এই ব্যাখ্যা থেকে আমরা বুঝতে পারি, ঠাকুর আর মা সারদার দিব্য দাম্পত্য, সেই সময়ের নিরিখে স্ত্রী-পুরুষের ভেদাভেদ কতটা দূর করেছিল। ভারতীয় সাধনার ধারায় রামকৃষ্ণ তাই সর্বার্থেই ব্যতিক্রমী সাধক।