ঈশ্বরের কৃপার জন্য আমরা অপেক্ষা করি। কারও প্রতি তাঁর কৃপা হয়। কারও প্রতি হয় না। কারোর প্রতি আবার অনেক দেরিতে কৃপা হয়। ভক্তমনে তাই সরল প্রশ্ন জাগে, ঈশ্বর কি তবে পক্ষপাতী? এ প্রশ্নের জবাব দিইয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। কী বলেছিলেন ঠাকুর সেদিন? আসুন শুনে নিই।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একবার নন্দ বসুকে বললেন, তোমার পণ্ডিতের মত, ‘যে যেমন কর্ম করবে সেরূপ ফল পাবে’; ওগুলো ছেড়ে দাও! ঈশ্বরের শরণাগত হলে কর্ম ক্ষয় হয়। আমি মার কছে ফুল হাতে করে বলেছিলাম, ‘মা! এই লও তোমার পাপ, এই লও তোমার পুণ্য; আমি কিছুই চাই না, তুমি আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার ভাল, এই লও তোমার মন্দ; আমি ভালমন্দ কিছুই চাই না, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার ধর্ম, এই লও তোমার অধর্ম; আমি ধর্মাধর্ম কিছুই চাই না, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার জ্ঞান, এই লও তোমার অজ্ঞান; আমি জ্ঞান-অজ্ঞান কিছুই চাই না, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার শুচি, এই লও তোমার অশুচি, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও।’
নন্দ বসু বললেন, আইন তিনি ছাড়াতে পারেন?
ঠাকুর বললেন, সে কি! তিনি ঈশ্বর, তিনি সব পারেন; যিনি আইন করেছেন, তিনি আইন বদলাতে পারেন।
আরও শুনুন: গৃহস্থের তপস্যার উপায় নেই, কোন পথ বলে দিয়েছিলেন ঠাকুর ও শ্রীশ্রীমা সারদা?
এখন প্রশ্ন হল, তিনিই যদি সব, তাহলে কারও প্রতি তাঁর কৃপা হয়, কারও হয় না। ঈশ্বর কি তাহলে পক্ষপাতী? নন্দ বসুই সে প্রশ্ন করেন ঠাকুরকে। ঠাকুর বলেন, তিনি নিজেই সব, ঈশ্বর নিজেই জীব, জগৎ সব হয়েছেন। যখন পূর্ণ জ্ঞান হবে, তখন ওই বোধ। তিনি মন, দেহ বুদ্ধি, দেহ — চতুর্বিংশতি তত্ত্ব সব হয়েছেন। তিনি আর পক্ষপাত কার উপর করবেন?
নন্দ বসু আবার জিজ্ঞেস করেন, তিনি নানারূপ কেন হয়েছেন? কোনখানে জ্ঞান, কোনখানে অজ্ঞান?
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, তাঁর খুশি। তারপর গান ধরলেন – সকলি তোমার ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি।
তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি।
পঙ্কে বদ্ধ কর করী, পঙ্গুরে লঙ্ঘাও গিরি,
কারে দাও মা! ব্রহ্মপদ, কারে কর অধোগামী।।
আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, আমি ঘর তুমি ঘরণী।
আমি রথ তুমি রথী, যেমন চালাও তেমনি চলি।।
গাইতে গাইতে ঠাকুর বলছেন, “তিনি আনন্দময়ী! এই সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের লীলা করছেন। অসংখ্য জীব, তার মধ্যে দু-একটি মুক্ত হয়ে যাচ্ছে, — তাতেও আনন্দ। ‘ঘুড়ির লক্ষের দুটো-একটা কাটে, হেসে দাও মা হাত চাপড়ি’। কেউ সংসারে বদ্ধ হচ্ছে, কেউ মুক্ত হচ্ছে।
“ভবসিন্ধু মাঝে মন উঠছে ডুবছে কত তরী!”
আরও শুনুন: সত্ত্ব, রজঃ আর তমঃ… কে কোন গুণের অধিকারী? চিনিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ
নন্দ বসু একটু বিস্ময়ে বললেন, তাঁর খুশি! আমরা যে মরি! শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, তোমরা কোথায়? তিনিই সব হয়েছেন। যতক্ষণ না তাঁকে জানতে পাচ্ছ, ততক্ষণ ‘আমি’ ‘আমি’ করছ! “সকলে তাঁকে জানতে পারবে — সকলেই উদ্ধার হবে, তবে কেহ সকাল সকাল খেতে পায়, কেহ দুপুর বেলা কেউ বা সন্ধ্যার সময়; কিন্তু কেহ অভুক্ত থাকবে না! সকলেই আপনার স্বরূপকে জানতে পারবে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ তাই বলেন, আমি কী, এটা খোঁজো দেখি। আমি কি হাড়, না মাংস, না রক্ত, না নাড়ীভুঁড়ি? আমি খুঁজতে খুঁজতে ‘তুমি’ এসে পড়ে, অর্থাৎ অন্তরে সেই ঈশ্বরের শক্তি বই আর কিছুই নাই। ‘আমি’ নাই! — তিনি। তোমার অভিমান নাই! এত ঐশ্বর্য। ‘আমি’ একেবারে ত্যাগ হয় না; তাই যদি যাবে না তবে থাক শ্যালা ঈশ্বরের দাস হয়ে। ঈশ্বরের ভক্ত, ঈশ্বরের ছেলে, ঈশ্বরের দাস, এ-অভিমান ভাল। যে ‘আমি’ কামিনী-কাঞ্চনে আসক্ত হয়, সেই ‘আমি’ কাঁচা আমি, সে ‘আমি’ ত্যাগ করতে হয়।
আমরা বুঝতে পারি, ঈশ্বর পক্ষপাতী নন। কাঁচা ‘আমি’র অবসান হলেই ঈশ্বরের কৃপা লাভ করা যায়।