সর্বসদ্গুণপূর্ণাং তাং
বন্দে ফাল্গুনিপূর্ণিমাম্।।
যস্যাং শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যোহ-
বতীর্ণঃ কৃষ্ণনামভিঃ।।
অর্থাৎ, যাহাতে শ্রীকৃষ্ণনামের সহিত মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, সকল সদগুণে পূর্ণা সেই ফাল্গুনপূর্ণিমাতিথিকে বন্দনা করি।
সে যেন এক অপ্রাকৃত রাত। ফাল্গুনি পূর্ণিমার দুধসাদা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। দোলের পূর্ণিমা তিথি। এমন রাতেই তিনি এসেছিলেন এই ধরাধামে। এ জগতে প্রেম বিলিয়ে দিতে এলেন মহাপ্রভু।
চৈতন্যচরিতামৃতে এই ফাল্গুনিপূর্ণিমাকেও তাই সম্মান দিয়ে বন্দনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে,
সর্বসদ্গুণপূর্ণাং তাং
বন্দে ফাল্গুনিপূর্ণিমাম্।।
যস্যাং শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যোহ-
বতীর্ণঃ কৃষ্ণনামভিঃ।।
অর্থাৎ, যাহাতে শ্রীকৃষ্ণনামের সহিত মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, সকল সদগুণে পূর্ণা সেই ফাল্গুনপূর্ণিমাতিথিকে বন্দনা করি।
সন-তারিখের হিসাবে সেটা ছিল ১৪০৭ শকাব্দ বা ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দ। সেদিনই সন্ধ্যাকালে নবদ্বীপে শচিমাতার কোল আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন মহাপ্রভু। সেই অসামান্য মুহূর্তের বর্ণনাও যেন আমাদের বহ্বল করে। … ” সে দিন পূর্ণিমা তিথি। রজত শুভ্র গগন-প্রদেশে ষোল কলায় পূর্ণশশী আনমনে রূপের বাজার খুলিয়া বসিয়াছিল। বারি-কল্লোল মুখরা গঙ্গায় আদুল বক্ষে তারকা বেষ্টিত চন্দ্রমণ্ডল প্রতিবিম্বিত। অনন্ত তরঙ্গ এক একটা প্রতিবিম্ব লইয়া কাড়াকাড়ি করিতেছিল। আকাশ-কুঞ্জে চাঁদের অপূর্ব শোভা দেখিয়া চিরক্রূর রাহু সেই অমল-জ্যোতি নিশাপতিকে গ্রাস করিবার করিবার জন্য ছুটিয়া আসিয়াছিল। ঠিক এই গ্রহণের সময় দরিদ্র ব্রাহ্মণ জগন্নাথ মিশ্রের ক্ষুদ্র কুটীরের ক্ষীণ দীপরশ্মি সহসা উজ্জ্বল করিয়া চৈতন্যদেব জন্মগ্রহণ করেন। এইরূপ জনশ্রুতি আছে যে, চৈতন্যদেব ত্রয়োদশ মাস মাতৃগর্ভে থাকিয়া চন্দ্রগ্রহণকালে ভূমিষ্ঠ হন। অকলঙ্ক গৌরচন্দ্রের উদয় দেখিয়া আকাশের কলঙ্কী চাঁদ বুঝি রাহুর কবলে মুখ লুকাইয়াছিল।’
মহাপ্রভুর জন্মক্ষণে এই গ্রহণের কথার নানা অর্থ প্রতিভাত হয়। চৈতন্যচরিতামৃত-এ কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলছেন,
ফাল্গুন-পূর্ণিমা সন্ধ্যায় প্রভুর জন্মোদয়।
সেই-কালে দৈবযোগে চন্দ্রগ্রহণ হয়।
হরি হরি বলে লোকে হরষিত হৈয়া
জন্মিলা চৈতন্যপ্রভু নাম জন্মাইয়া।।
তাঁর আসার মুহূর্তে সংকীর্তনে মুখর ছিল চতুর্দিক। কীভাবে? না, সেই সময়ই যে চাঁদে গ্রহণ লেগেছে। আর তাই সকলে সমস্বরে হরির নাম গাইছেন। শ্রীশ্রীচৈতন্যভাগবত-এ ব্ররন্দাবন দাস ঠাকুর সেই বর্ণনা দিয়ে বলছেন,
শচী গর্ভে বৈসে সর্ব ভুবনের বাস।
ফাল্গুনি পূর্ণিমা আসি হইল প্রকাশ।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে যত আছে সুমঙ্গল।
সেই পূর্ণিমায় আসি মিলিলা সকল।।
সঙ্কির্তন সহিত প্রভুর অবতার
গ্রহণের ছলে তাহা করেন প্রচার।।
ঈশ্বরের কর্ম বুঝিবার শক্তি কায়।
চন্দ্রে আচ্ছাদিল রাহু ঈশ্বর-ইচ্ছায়।।
সর্ব নবদ্বীপে দেখে হইল গ্রহণ।
উঠিল মঙ্গল ধ্বনি শ্রীহরি কীর্তন।
…
কিবা শিশু বৃদ্ধ নারী সজন দুর্জন।
সবে ‘হরি হরি’ বলে দেখিয়া গ্রহণ।।
হরি বোল হরি বোল সবে এই শুনি
সকল ব্রহ্মাণ্ডে ব্যাপিলেক হরিধ্বনি
চতুর্দিকে পুষ্পবৃষ্টি করে দেবগণ
জয়-শব্দে দুন্দুভি বাজয়ে অনুক্ষণ।
হেনই সময়ে প্রভু জগত-জীবন
অবতীর্ণ হইলেন শ্রীশচীনন্দন।।
সেই সময়কালের দিকে যদি আমরা তাকাই, তবে দেখব সে-ও যেন এক গ্রহণকাল। নানা কারণে তখন অবতারের আবির্ভাব যেন অবধারিত হয়ে উঠেছিল। তারই প্রেক্ষাপট যেন রচিত হয়েছে চন্দ্রগ্রহণের রূপকে। যে হরিধ্বনির মধ্যে মহাপ্রভুর আগমন, সেই নামই তো উত্তরকালে হয়ে উঠবে তাঁর হাতিয়ার। নাম আর প্রেমে তিনি মাতিয়ে দেবেন ভুবন। জাত-পাতের থাক ভেঙে যাবে তাঁর অনাবিল প্রেমে। গোটা সমাজ তাঁর হাত ধরে সাক্ষী হবে এক আমূল পরিবর্তনের। তারই সূচনাগ্নটি এই দোলপূর্ণিমা তিথি। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম গৌরাঙ্গের ভাবে জারিত হয়েই তো এই বাংলাকে দেবে নতুন একটা রূপ। দোলের অনুষঙ্গে তাই মগাপ্রভুর সেই বিরাট সামাজিক আন্দোলনটিকেও আমরা স্মরণ করি। আজও যে সব বিভাজন মুছে আমরা দোলের দিনে সম্প্রীতির রং-এ এক হয়ে যাই, সে বুঝি মহাপ্রভুরই আশীর্বাদ।