একখানা ভাবনা এল তাঁর মনে। আর তাতে বেশ চমকেই গেলেন নরেন্দ্রনাথ। তিনি জানেন, তিনি বেশ শক্ত মনের মানুষ। সেই শক্ত মনটাকে যিনি ভেঙে-চুরে এমন করে নিজের মতো করে নিতে পারেন, সেই মানুষটা তাহলে কেমন! কতখানি শক্তিসম্পন্ন তিনি! এই ভাবনার উদয় হতেই নরেন্দ্রনাথ বিস্ময়ে ঠাকুরের দিকে চাইলেন।
ঠাকুরের অলৌকিক স্পর্শে যখন চোখের সামনে গোটা বিশ্ব দুলে উঠল, হাহাকার করে উঠলেন তিনি – তখন থেকেই ঠাকুরকে এক অপার বিস্ময় মনে হতে লাগল নরেন্দ্রনাথের। এর আগে কত না পড়াশোনা করেছেন তিনি। নানাবিধ বিষয়ে তাঁর অগাধ জ্ঞান। অথচ তাঁর নিজের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটল, তার যেন কোনও ব্যাখ্যাই খুঁজে পাচ্ছেন না যুবক নরেন্দ্রনাথ। মনে মনে ভাবছেন, এটা কী হল? কেনই বা হল এরকম? ‘মেসমিরিজম’ আর ‘হিপনোটিজম’ নিয়ে আগে তিনি পড়াশোনা করেছেন। সে জিনিস সম্পর্কে তাঁর ধারণা আছে। একটা হল মোহিনী ইচ্ছাশক্তি সঞ্চারণ, অপরটি হল সম্মোহনবিদ্যা। ঠাকুর কি এরকম কিছু বিদ্যারই প্রয়োগ করলেন তাঁর উপর? ভাবতে থাকেন নরেন্দ্রনাথ। পরক্ষণেই তাঁর মনে হয়, তা কী করে হবে? ওই ধরনের বিদ্যার প্রয়োগ হয় দুর্বল মনের উপর। তিনি তো দুর্বল মনের মানুষ নন। নরেন্দ্রনাথ নিজেকে বেশ ভালই চেনেন। নিজের মানসিক জোর সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। নিয়মিত ধ্যান করেন তিনি। নিজের মনের উপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে তাঁর। তাঁর মন এমনধারা দুর্বল নয়, যে, সেখানে সম্মোহনবিদ্যা কাজ করবে! তা-ই যদি হবে, তাহলে তাঁর সঙ্গে যে ঘটনা ঘটল, বলা ভালো যে অসম্ভব কাণ্ড ঘটালেন ঠাকুর, তার ব্যাখ্যাটাই বা তবে কী! ভেবে আর যেন তল পান না নরেন্দ্রনাথ। তাঁর মনে পড়ল মহাকবির কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে ও স্বর্গে এমন অনেক তত্ত্ব আছে, মানব-বুদ্ধি-প্রসূত দর্শনশাস্ত্র যাহাদিগের স্বপ্নেও রহস্যভেদের কল্পনা করিতে পারে না।’ নরেন্দ্রনাথ ভাবলেন, এরকমই একটা কিছু তাঁর সঙ্গে হয়েছে। শাস্ত্রে পাওয়া জ্ঞান দিয়ে সবকিছুর মীমাংসা হয় না। শাস্ত্রের অতীত, এ মহাবিশ্বে আরও বহুকিছু থেকে যায়। থেকে যেতে পারে। তাকে যত জানার চেষ্টা করা হয়, তত যেন কম মনে হয়। সেই অনন্তকে জানা আর কিছুতেই ফুরোয় না। তবে একটা বিষয়ে তিনি সাবধান হয়ে গেলেন। ওই অদ্ভুত পাগল মানুষটা যে করেই হোক তাঁর উপর প্রভাব বিস্তার করেছেন – এ কথা তো ঠিক। আর যেন সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। নিজেকে শক্ত করতে মনে জোর আনলেন নরেন্দ্রনাথ।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৩): ঠাকুর পা তুলে দিলেন কোলে, নরেন্দ্রনাথের সামনে দুলে উঠল গোটা বিশ্ব
একটু পরেই আর একখানা ভাবনা এল তাঁর মনে। আর তাতে বেশ চমকেই গেলেন নরেন্দ্রনাথ। তিনি জানেন, তিনি বেশ শক্ত মনের মানুষ। সেই শক্ত মনটাকে যিনি ভেঙে-চুরে এমন করে নিজের মতো করে নিতে পারেন, সেই মানুষটা তাহলে কেমন! কতখানি শক্তিসম্পন্ন তিনি! এই ভাবনার উদয় হতেই নরেন্দ্রনাথ বিস্ময়ে ঠাকুরের দিকে চাইলেন। দেখলেন, এতবড় ঘটনা যে ঘটে গেছে, ঠাকুরের তাতে যেন কোনও হেলদোলই নেই। যেন বহুদিন পর সখার সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাতেই তিনি আনন্দে মশগুল। মানুষটা এত সাধারণ ব্যবহার করছেন যে কোনওরকম সংশয়, সন্দেহের অবকাশই কোথাও থাকছে না। হাসছেন, স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছেন। নরেন্দ্রনাথকে খাওয়াচ্ছেন। নরেন্দ্রনাথ যত তাঁকে দেখছেন, তত যেন তাঁর ঘোর লেগে যাচ্ছে। এই ভীষণ সহজ সরল মানুষটার মধ্যে যে অপার রহস্যের খনি আছে, এবার তিনি তা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন। একটু আগে ঠিক করেছিলেন, মানুষটা যাতে তাঁকে আর জাদু না করতে পারে, সেই ব্যাপারে সাবধানে থাকবেন। এবার মত বদলালেন। ঠিক করলেন, এই অদ্ভুত মানুষটার স্বভাব আর শক্তি সম্পর্কে তাঁকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। যেভাবে হোক মানুষটাকে চিনতেই হবে।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২): ঠাকুরের আচরণ দেখে নরেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন মানুষটা ‘অদ্ভুত পাগল’
দেখতে দেখতে বেলা পড়ে এল। বিকেলের আলো ম্লান হয়ে সন্ধের দিকে গড়াচ্ছে। সাত-পাঁচ ভাবনার ভিতর নরেন্দ্রনাথ এবার বিদায় নেবেন বলে মনস্থির করলেন। ঠাকুরকে বললেন সে কথা। রঙ্গ-পরিহাসমুখর ঠাকুরের আনন্দের হাট যেন ভাঙল সহসা। তিনি একটু ক্ষুণ্ণ হলেন। তারপর বিষণ্ণ মুখে নরেন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বলো আবার আসবে?’ যেই না ঠাকুর এ কথা বললেন, সঙ্গে সঙ্গেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল নরেন্দ্রনাথের এত ভাবনা, এত সংকল্প! ঠাকুরের সেই জোরাজুরির সামনে তিনি সম্মোহিতের মতোই বলে ফেললেন, আসব।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১): তিনি নররূপী নারায়ণ, এসেছিলেন জীবের দুর্গতি নিবারণে
আবার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন নরেন্দ্রনাথ। আসবেন তিনি দক্ষিণেশ্বরে, ঠাকুরের কাছে। মহাকাল জানে, তাঁকে যে এখানে আসতেই হবে। একবার দুবার নয়, বারেবারেই।