পুজোর সময় তো বটেই, এমনকী যে কোনও শুভকাজের শুরুতে প্রদীপ জ্বালানোর রীতি রয়েছে, আমরা জানি। আমরা তা করেও থাকি। কিন্তু কেন পুজোর সময় প্রদীপ জ্বালানো হয়? এর কি আলাদা কোনও মাহাত্ম্য রয়েছে, নাকি তা নিছকই প্রথা? আসুন, শুনে নিই।
হিন্দুদের যে কোনও পুজোর মানেই জ্বলে ওঠা প্রদীপের শিখা। কাঁপা-কাঁপা শিখা, ধূপের সুবাস আর মন্ত্রোচ্চারণে এক অনির্বচনীয় পরিবেশ তৈরি হয় পুজোর সময়। আমাদের মনপ্রাণ যে ঈশ্বরের প্রতি সমর্পিত হয়, সেই আবহ তৈরি হয়ে যায় এই উপকরণের মাধ্যমেই। পুজোর সময় প্রদীপ জ্বালানো তাই একটি আবশ্যিক কাজ। তবে শুধুই কি এটি একটি প্রথা মাত্র! এর কি অন্য কোনও তাৎপর্য নেই? নিশ্চিতই আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রথা বলি রীতি বলি কিংবা রেওয়াজ- তা মানুষের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার পথ ধরেই এসেছে। তাই, পুজোর সময় যে প্রদীপ জ্বালানো হয়, তারও নির্দিষ্ট কার্যকারণ আছে।
আরও শুনুন: Vastu Tips: ঘরের কোন দিকে তুলসী গাছ রাখা উচিত? কোন কোন দিন গাছে জল দেবেন না?
আজ, পিছু ফিরে দেখলে দেখা যাবে, একটা সময় পুজো-অর্চনায় প্রদীপ জ্বালানো হত না। কিন্তু পুজোর জায়গায় আগুনের ভূমিকা সেদিনও ছিল। যজ্ঞবেদীতে জ্বলে উঠত পবিত্র অগ্নি। ঈশ্বরকে তখন নিরাকার হিসেবেই উপাসনা করা হত। করা হত, হোম-যজ্ঞ। পরবর্তীতে যখন ঈশ্বরকে সাকার রূপে কল্পনা করতে শুরু করল মানুষ, তখন বেশ কিছু প্রথা তার সঙ্গে যুক্ত হল। যেমন, ঠাকুরকে অন্ন বা ভোগ দেওয়া, পোশাক পালটানো, স্নান, শয়ন ইত্যাদি রীতি যোগ হল। একই সঙ্গে সুগন্ধীর ব্যবহার এবং ধূপ ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলনও পুজোর অঙ্গ হয়ে উঠল। যেন, সেই হোমকুণ্ডের আগুনই দেখা দিল একটু অন্যরকম ভাবে।
আরও শুনুন: সকল দেবদেবীদের মধ্যে কেন গণেশের পুজো আগে হয়?
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সেই পুরনো দিনকালে, মানুষ প্রদীপ জ্বালাতেন নিজেদের প্রয়োজনে। যাতে, বাড়ি চেনা যায়। বা অন্ধকারে কোনও আগন্তুক যাতে সঠিক ভাবে বাড়ি চিনতে পারে, সেই জন্য। আজও এই প্রথার চিহ্ন আমরা দেখি। বাড়ি বাড়ি সন্ধ্যাকালে দীপ জ্বালানো হয়। ঈশ্বরের সামনে প্রদীপ জ্বালানোর ক্ষেত্রে মানুষের সেই প্রথারই ছাপ পড়ে আছে বলে অনেকে মনে করেন। আবার কেউ কেউ বলেন, এই যে দীপ জ্বালানোয় সকল অন্ধকার দূর হয়, ঈশ্বরের উপসনার ক্ষেত্রেও তো তা সত্যি। প্রদীপ জ্বালানোর রীতির মধ্যে সেই আলোকের পূজার রীতিও রয়ে আছে, যে আলোক সকল কলুষ থেকে মানুষকে মুক্ত করে। আগুন মানব সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। আর তাই মানুষের ঈশ্বর উপাসনা বা পৌরাণিক নানা বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আগুন। আগুন ক্ষুধার প্রতীক, কখনও আবার আগুন জীবনের প্রতীক। একই সঙ্গে আগুন আবার জ্ঞান বা প্রজ্ঞার প্রতীক হিসেবেও ফিরে ফিরে এসেছে। আমাদের উপাসনায় তাই অগ্নির ভূমিকা চিরকালীন। সেই পবিত্র আগুনই একসময় জ্বলত যজ্ঞবেদীতে। আজ যা দেখা যায় প্রদীপে। তাই পুজো-অর্চনায় প্রদীপ জ্বালানোর যে রীতি, তা যেমন প্রাচীন তেমনই অর্থবহ।