ঠাকুর বিড়বিড় করতে করতে তাঁর ডান পা-খানা তুলে দিলেন নরেন্দ্রনাথের কোলে। আচমকা যেন গোটা বিশ্ব দুলে উঠল নরেন্দ্রনাথের চোখের সামনে। নরেন্দ্রনাথ চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলেন, সমস্ত ঘরটা, ঘরের দেওয়ালগুলো প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে মহাশূন্যে লীন হয়ে যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে তাঁর ভিতরের যে আমিত্ব তাও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হাহাকার করে উঠলেন নরেন্দ্রনাথ! চিৎকার করে বললেন, ‘ওগো, তুমি আমায় একি করলে, আমার যে বাপ-মা আছেন!’
দক্ষিণেশ্বর থেকে বিদায় নিলেন নরেন্দ্রনাথ। খানিক হতচকিত, বিস্মিত। এর আগে ঠাকুরকে তিনি একবারই দেখেছিলেন। তবে ঠাকুরের এরকম ব্যবহার তো আগে দেখেননি। এমনধারা মানুষের সঙ্গে যুবক নরেন্দ্রনাথের আগে কখনও সাক্ষাৎ হয়নি। এদিকে ঠাকুরের জোরাজুরিতে বলে দিয়েছেন যে, আবার আসব। কিন্তু সত্যিই আর দক্ষিণেশ্বরে আসবেন কিনা তিনি জানেন না। ঠাকুরকে একবার তাঁর মনে হচ্ছে, পাগল। পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, মহাপবিত্র একজন মানুষ। নরেন্দ্রনাথের মনের ভিতর যেন দুরকম স্রোতের ঘূর্ণি।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১): তিনি নররূপী নারায়ণ, এসেছিলেন জীবের দুর্গতি নিবারণে
নরেন্দ্রনাথ তো চলে গেলেন সেদিনকার মতো। এদিকে তিনি চলে যেতেই ঠাকুরের বুকের ভিতরটা যেন ফাঁকা হয়ে গেল। যন্ত্রণার মোচড়ে কাতর হয়ে উঠলেন ঠাকুর। জেগে উঠল তাঁর বিরহভাব। যেন কৃষ্ণের অদর্শনে রাধার ভাব। চব্বিশটি ঘণ্টা কাটল অদ্ভুত এক যন্ত্রণায়। এক একটা ঘণ্টা পেরোয় আর ঠাকুরের প্রাণ হু হু করে। নরেন্দ্রনাথের জন্য তাঁর প্রাণ এমন ব্যাকুল হয়ে রইল যে আর বলার নয়। সময়ে সময়ে এমন যন্ত্রণা হত যে, ঠাকুর রীতিমতো অস্থির হয়ে উঠতেন। ঠাকুরের মনে হত বুকের ভিতরটা যেন কে গামছা নিংড়াবার মতো জোর করে নিংড়াচ্ছে! তখন আর নিজেকে সামলাতে পারতেন না। ছুটে বাগানের উত্তর দিকের ঝাউতলায় চলে যেতেন। সেখানে কেউ বড় একটা যায় না। সেই ফাঁকা জায়গায় গিয়ে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠতেন। কাঁদতেন আর বলতেন,‘ওরে তুই আয়রে, তোকে না দেখে আর থাকতে পারচি না’। অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পর, তবে ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিতে পারতেন। ঠাকুর পরে বলেছিলেন, ‘আর সব ছেলেরা যারা এখানে আসিয়াছে, তাদের কাহারও কাহারও জন্য কখনও কখনও মন কেমন করিয়াছে, কিন্তু নরেন্দ্রের জন্য যেমন হইয়াছিল তাহার তুলনায় সে কিছুই নয় বলিলে চলে।”
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২): ঠাকুরের আচরণ দেখে নরেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন মানুষটা ‘অদ্ভুত পাগল’
এদিকে ঠাকুর যখন তাঁর জন্য ব্যাকুল, সেই সময়টায় নরেন্দ্রনাথের দিন যায় হাজার কাজে। তাঁর পড়াশোনা আছে, সভা-সমিতিতে নানারকম বিষয়ে আলোচনা চলছে। সেই সব নিয়ে মেতে আছেন যুবক। আর গোপনে চলছে সাধনা। ধ্যান-তপস্যা করছেন নিয়মিত। সেই সঙ্গে শরীরচর্চাতেও খামতি রাখছেন না। গান গাইতে ভালোবাসেন নরেন্দ্রনাথ, তারও চর্চা করছেন। হাজার কাজে ব্যস্ত হয়ে আছেন, আর তারই মধ্যে থেকে থেকে মনে পড়ছে ঠাকুরের কথা। মনে পড়ছে, কথা দিয়েছিলেন তিনি নিজে যে, আবার দক্ষিণেশ্বরে আসবেন। কিন্তু সত্যি আর যাবেন কি? নরেন্দ্রনাথ যেন নিজেই নিজের সঙ্গে সুদ্ধ করছেন। দেখতে দেখতে এক মাস পেরিয়ে গেল। একদিন মনস্থি করে একা একা চললেন ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। আগেরবার গিয়েছিলেন গাড়ি করে। এবার চলেছেন পায়ে হেঁটে। কলকাতা থেকে দক্ষিণেশ্বর- রাস্তা যে এতখানি, আগে আন্দাজ করতে পারেননি। হাঁটছেন তো হাঁটছেন, পথ যেন আর ফুরোয় না। একে ওকে জিজ্ঞেস করছেন। সকলে পথ বাতলে দিচ্ছেন। বেশ কষ্ট করেই এবার নরেন্দ্রনাথ চলেছেন দক্ষিণেশ্বরে।
পৌঁছে দেখলেন নিজের ঘরের ভিতর ঠাকুর বসে আছেন একা। আর কেউ নেই আশেপাশে। নরেন্দ্রনাথ ঢুকতেই ঠাকুরের সে কী আহ্লাদ! ডেকে বসালেন নিজের পাশটিতে। তারপর মনে মনে কী যেন আবৃত্তি করতে শুরু করলেন। ঠাকুরের ভাবখানা আচ্ছন্ন। তন্ময় হয়ে আছেন নিজের মধ্যে। নরেন্দ্রনাথ মনে মনে ভাবছেন, আবার বুঝি পাগল ঠাকুর কিছু একটা পাগলামি করবেন, ঠিক আগের দিনের মতোই। একটু পরেই ঠাকুর বিড়বিড় করতে করতে তাঁর ডান পা-খানা তুলে দিলেন নরেন্দ্রনাথের কোলে। আচমকা যেন গোটা বিশ্ব দুলে উঠল নরেন্দ্রনাথের চোখের সামনে। নরেন্দ্রনাথ চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলেন, সমস্ত ঘরটা, ঘরের দেওয়ালগুলো প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে মহাশূন্যে লীন হয়ে যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে তাঁর ভিতরের যে আমিত্ব তাও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হাহাকার করে উঠলেন নরেন্দ্রনাথ! চিৎকার করে বললেন, ‘ওগো, তুমি আমায় একি করলে, আমার যে বাপ-মা আছেন!’ তাঁর কথা শুনে ঠাকুর খলখল করে হেসে উঠলেন। তারপর হাতখানা রাখলেন নরেন্দ্রনাথের বুকের উপর। বলতে থাকলেন, ‘তবে এখন থাক, একেবারে কাজ নেই। কালে হবে।’ ঠাকুরের হাতের ছোঁয়া পেয়ে আস্তে আস্তে প্রকৃতিস্থ হলেন নরেন্দ্রনাথ। দেখলেন, সব আবার ঠিক আগের মতোই আছে। কোথাও কিছু বদলায়নি। শুধু বদলে গিয়েছে তাঁর ভিতরটা।
মাঝের ওই কয়েক লহমা ঠিক কী হয়েছিল? কী দেখলেন তিনি? ঠাকুরকে দেখছেন আর ভাবনার অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন নরেন্দ্রনাথ। কে এই পাগল ঠাকুর? বিস্মিত নরেন্দ্রনাথ যেন সমুদ্রের তল খুঁজতে চাইছেন। যত হাতড়ান তত দেখেন তল আর মেলে না। ঠাকুর যে এক গভীর বিস্ময়, ক্রমে যেন এবার সেই উপলব্ধিতে পৌঁছচ্ছেন নরেন্দ্রনাথ।