মা কালীর দর্শন তো ঠাকুর পেয়েইছিলেন। ঠাকুর এবার ভগবানের আরও রূপ দেখার জন্য আকুল হয়ে উঠলেন। সেই কোন ছোটবেলা থেকেই শুনেছেন নরচন্দ্রমা শ্রীরামচন্দ্রের কথা। সেই রামকে দর্শনের জন্যই এবার পাগল হলেন ঠাকুর।
ঠাকুর যখন আর কিছুতেই নিজেকে নিয়মের গণ্ডিতে বেঁধে রাখতে পারলেন না, তখন প্রতিদিনের নিয়ম মেনে পূজার্চনা করাও তাঁর কাছে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া সেই সময় ঠাকুর যেভাবে ভাবে উন্মাদ হয়ে থাকতেন, তার প্রভাব পড়ছিল শরীরের উপরেও। একটা সময় নিত্যবিধি মেনে পূজার ভার দেওয়া হল ঠাকুরের ভাগনা হৃদয়কে। তিনি তখন ঠাকুরের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরেই থাকতেন।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২১): ঠাকুরের আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় পেয়েছিলেন রানি রাসমণি
ঠাকুরও যেন এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। নিজের আধ্যাত্মিক সাধনায় আরও এগিয়ে যাবেন বলে মনস্থ করলেন। মন্দিরের সামনে যে আমলকি গাছের তলায় বসে তিনি ধ্যান করতেন, তার আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করে আরও কয়েকটি গাছ লাগালেন। এই স্থানটিই ঠাকুরের সাধনার ক্ষেত্র। পরবর্তীকালে যা পঞ্চবটী নামে সকলের কাছে পরিচিত হয়।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২০): ঠাকুরের পুজোর ধরনে রেগে আগুন কর্মচারীরা, পাশে ছিলেন রানিমা
মা কালীর দর্শন তো ঠাকুর পেয়েইছিলেন। ঠাকুর এবার ভগবানের আরও রূপ দেখার জন্য আকুল হয়ে উঠলেন। সেই কোন ছোটবেলা থেকেই শুনেছেন নরচন্দ্রমা শ্রীরামচন্দ্রের কথা। সেই রামকে দর্শনের জন্যই এবার পাগল হলেন ঠাকুর। রামচন্দ্রের পরম ভক্ত হনুমান। তাঁর ভক্তি, আরাধ্যের প্রতি তাঁর সমর্পণ তুলনারহিত। ঠাকুর তাই নিজেকে, নিজের মনকে বানর অধিনায়ক মহাবীরের ধাঁচে গড়ে তুললেন। নিজেকে রামের অনুগত ভক্ত হিসাবেই তখন দেখছেন তিনি। মুখে সর্বদা রঘুবীরের নাম। আচার আচরণেও এল পরিবর্তন। এমনকী কখনও কখনও গাছের ডাল ধরে লাফিয়ে চলতেন বলেও অনেকের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়।
আবারও আমাদের সেই একই কথা মনে করতে হবে। ঠাকুরের এই পর্বের যে আচার-আচরণ, তাকে কখনই সাধারণ বিচারের দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়। তাহলেই ভুল হয়ে যাবে। যে দিব্য ভাবে তিনি বিভোর, আমরা সাধারণ বিচারবুদ্ধিতে তার নাগাল পেতে পারি না। শুধু এই অপ্রাকৃত ভাবটুকু আস্বাদ করতে পারি।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৯): কবরস্থানে বসেও মা ভবতারিণীর ধ্যান করেছিলেন ঠাকুর
একদিন এভাবেই পঞ্চবটীতে বসে আছেন ঠাকুর। হঠাৎ দেখলেন, বাগানের উত্তর দিক থেকে এক স্ত্রীমূর্তি তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন। ঠাকুর তখন সজাগ ছিলেন। আশাপাশে তাকিয়ে দেখলেন। বাগানের গাছপালাকে যেমন তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, সেভাবেই দেখলেন সেই স্ত্রীমূর্তিকে। ঠাকুর মনে মনে ভাবলেন, কে ইনি? সেই মানবী-মূর্তি যখন ঠাকুরের কাছাকাছি চলে এসেছেন, তখন গাছ থেকে লাফিয়ে নামল একটি হনুমান। আনন্দে চিৎকার করে সে পরম ভক্তিভরে সেই স্ত্রীমূর্তির চরণ বন্দনা করল। চকিতে ঠাকুরের মন বলে উঠল, ইনিই মা সীতা। রোমাঞ্চিত হলেন ঠাকুর। ‘মা … মা’ বলে তখনই তাঁর পায়ে গিয়ে লুটিয়ে পড়লেন। আর বিস্ময়ে খেয়াল করলেন, সেই মূর্তি তাঁর আরও কাছে এগিয়ে এল। তারপর তাঁরই শরীরের ভিতর প্রবেশ করে তাঁর সত্তার সঙ্গে মিশে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, ‘আমার হাসিটি তোমায় দিয়ে গেলাম।’
আজও আমরা ঠাকুরের মুখে দেখি সেই প্রসন্ন হাসি। ঠাকুর যে সমন্বয়ের আদর্শ পরবর্তীতে প্রচার করবেন, তার নেপথ্যে থেকে গিয়েছে এই ঘটনাগুলিও। ঠাকুরের সাধনপদ্ধতি ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র। বহুরূপে তিনি ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সব মত ধরেই এগিয়ে এক ঈশ্বরের সন্ধান পেয়েছিলেন। আর তাই পরবর্তীতে কোনও ভেদাভেদকেই ঠাকুর কখনও প্রশ্রয় দেননি।