সেটা ১২৮৮ বঙ্গাব্দ। হেমন্ত ফুরিয়ে আসছে তখন। ইংরাজি ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ। বোধকরি নভেম্বর মাস। সুরেন্দ্রর বাড়িতে এসেছেন ঠাকুর। তাঁকে গান শোনানোর জন্য সুরেন্দ্র তাঁরই প্রতিবেশী এক যুবককে ডাক পাঠিয়েছিলেন। যুবক তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এফ এ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। প্রতিবেশীর আহ্বানে তিনি এলেন গান শোনাতে। আর সেই হেমন্তের শেষবেলায় এই পৃথিবীতে ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ এবং নরেন্দ্রনাথ সেই প্রথমবার দেখলেন একে অপরকে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন, তাঁরা সব একে একে আসবে। তাঁদের যে আসতেই হবে। এই পৃথিবীতে যখন যখন তাঁদের দরকার পড়েছে, একে একে তাঁরা এসেছেন। করেছেন জগতের মঙ্গলসাধন। এই যে ঠাকুর নিজে আসরখানা খুলে রেখেছেন, আপাতত সেখানে তিনি একা। চারিদকে কত না মতের বিভেদ! শুধুই ‘আমি’র প্রকাশ। প্রত্যেকেই নিজেকে সেরা প্রমাণে ব্যস্ত। ঠাকুর দেখছেন সবই। ধীরে ধীরে তৈরি করছেন ক্ষেত্র। আগে তো আবহ সম্পূর্ণ হোক। তারপর জোরকদমে নেমে পড়া যাবেখন। তখন এমনি ধুম উঠবে যে, আর কিচ্ছুটি গোপন থাকবে না। ঠাকুর জানেন, তাঁর লীলায় পুষ্টি জোগাতে এই ধরাধামে নেমে আসবেন উচ্চশ্রেণির সাধকরা। ঠাকুর তাঁদের জন্যই অপেক্ষা করছেন। আর আসবেন সেই একজন। পদ্মমধ্যে যে সহস্রদল। ঠাকুর তাঁর জন্যেও তো অপেক্ষা করছেন।
আরও শুনুন – তিনি লক্ষ্মী আবার তিনিই সরস্বতী, মায়ের কাছেই অনন্ত ঐশ্বর্যের খোঁজ
সিমলার সুরেন্দ্রনাথ মিত্র একদিন দক্ষিণেশ্বরে গিয়েছিলেন। ঠাকুরের দর্শন লাভ করে খুব আনন্দ পান। মনে সাধ, ঠাকুরকে একদিন নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। ঠাকুরও সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। আর হবেন না-ই বা কেন! একটা অবশ্যম্ভাবী ঘটনা যে ক্রমশ পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে, তা কি তিনি জানতেন না! সেটা ১২৮৮ বঙ্গাব্দ। হেমন্ত ফুরিয়ে আসছে তখন। ইংরাজি ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ। বোধকরি নভেম্বর মাস। সুরেন্দ্রর বাড়িতে এসেছেন ঠাকুর। তাঁকে গান শোনানোর জন্য সুরেন্দ্র তাঁরই প্রতিবেশী এক যুবককে ডাক পাঠিয়েছিলেন। যুবক তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এফ এ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। প্রতিবেশীর আহ্বানে তিনি এলেন গান শোনাতে। আর সেই হেমন্তের শেষবেলায় এই পৃথিবীতে ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ এবং নরেন্দ্রনাথ সেই প্রথমবার দেখলেন একে অপরকে। ঠাকুর জানতেন, তিনি আসবেনই। না এসে তিনি থাকতে পারেন না। ঠাকুর তাই সলতে পাকানোর কাজটি করেই রেখেছিলেন। এবার শুধু অগ্নিসংযোগ আর অনির্বাণ শিখার জ্বলে ওঠা। জগৎ দখবে, কী তেজ সেই বহ্নির। একা একজন মানুষ কীভাবে একটা গোটা দেশের, জাতির ভাব, ভাবনা বদলে দিতে পারে, অচিরেই তার সাক্ষী থাকবে পৃথিবী। আর সেই যে যুগল যাত্রা, ঠাকুর আর তাঁর শিষ্যের, তার শুরুটা হল সুরেন্দ্রর বাড়িতেই।
আরও শুনুন – মন একাগ্র করলেই সারে অসুখ, তবে ঠাকুর নিজেকে সুস্থ করলেন না কেন?
গান শোনাতে এসেছে যুবক। তা কী গান গাইবে গা? বাংলা গান সে যুবক দু-চারটিই জানে। ধরেছেন একখানা ভজন। এদিকে যুবককে দেখে ঠাকুরের যে আর চোখ ফেরে না। একবার সুরেন্দ্রকে একবার অন্যকে জিজ্ঞেস করেন, কে এই যুবক? তাঁর পরিচয় জেনে নিচ্ছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ঠাকুর যেন চিনতে পেরেছেন। অনন্তের যে সাধকের নেমে আসার কথা সপ্তর্ষিমণ্ডল থেকে, এই কি সে? ঠাকুর যুবকের কাছে এলেন। দেখলেন তাঁকে ভালো করে। অঙ্গপরীক্ষা করে যেন মিলিয়ে নিচ্ছেন সকল লক্ষ্মণ। আহা আনন্দ আজ ঠাকুরের মনে। যুবককে বললেন, তুমি দক্ষিণেশ্বরে এসো। যুবক ঘাড় নাড়লেন। কী জানি, কী তার ইচ্ছা বোঝা গেল না।
আরও শুনুন: ঠাকুর বলতেন, সত্যনিষ্ঠা থাকলে জগদম্বা বেচালে পা পড়তে দেন না…
এর মধ্যে এফ এ পরীক্ষা শেষ হল। নরেন্দ্রনাথের জন্য পাত্রী দেখলেন তাঁর বাবা। কিন্তু তাঁর ভারী জেদ। বিয়ে তিনি কিছুতেই করবেন না। অন্তরে অন্তরে কী যেন একটা খুঁজে চলেছেন অবিরাম। কাকে যেন খুঁজছেন। কিন্তু পাচ্ছেন কই! বিবাহ নয়, সংসার নয়, হেথা নয় হোথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোনখানে যেন তাঁর গন্তব্য। যুবক নরেন্দ্রনাথ চাতকের মতো সেই দর্শনের অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু কার দর্শন? সেইটেই বোঝা যায় না। তত্ত্ব পড়েছেন ঢের! শাস্ত্র পড়েছেন খুঁটিয়ে। ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত আছে। কিন্তু শান্তি কোথায়! একদিন বাবা বিশ্বনাথ দত্ত বললেন, যদি ধর্মেই মন থাকে তাহলে এখানে সেখানে না ঘুরে দক্ষিণেশ্বরে যাও। চমকে উঠলেন নরেন্দ্রনাথ। প্রতিবেশী সুরেন্দ্রনাথও তাঁকে দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার কথা বলছিলেন। আর অনুরোধ করেছিলেন সেই মানুষটা। সেই একদিন কয়েক মুহূর্তের জন্যই তো দেখা। সকলেই দক্ষিণেশ্বর যেতে বলছে কেন? কী এমন আছে জিনিস আছে দক্ষিণেশ্বর! কেন তার এত টান!
আরও শুনুন: মানুষ কি নিজের মন্দ কাজের ভারও ঈশ্বরের উপর চাপাতে পারে?
আর দেরি করলেন না নরেন্দ্রনাথ। চললেন দক্ষিণেশ্বর। গঙ্গার দিকে পশ্চিমের দরজা দিয়ে তিনি ঢুকলেন। আর ঠাকুরের মনে আবার খেলে গেল সেই অপার আনন্দের ঢেউ। ঠাকুর মনে মনে দিনটার একটা ছবি এঁকে নিলেন। আসছেন নরেন্দ্রনাথ। মাথার চুল এলোমেল। বেশভূষায় পরিপাট্য নেই। জাগতিক কোনও বিষয়েই যেন তার আঁট নেই। চোখ দুটোর দিকে তাকালেন ঠাকুর। মনে হল, কে যেন তাকে অনেকটা ভিতরের দিকে সর্বক্ষণ টেনে রেখেছে। কলকাতা জুড়ে বিষয়ী লোকের আনাগোনা। যুবকের সঙ্গেও যে ক-জন বন্ধুবান্ধব এসেছে, সকলেই আলাদা; সবার মধ্যে স্বতন্ত্র যেন প্রদীপের শিখার মতো জ্বলছেন যুবক নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর মনে মনে ভাবলেন, এই কলকাতাতে সত্ত্বগুণের এতবড় আধার থাকাও কি সম্ভব!
আরও শুনুন: কেন কল্পতরু হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ?
মেঝেয় ছিল মাদুর পাতা। যুবককে তিনি বসতে বললেন। গঙ্গজলের পাত্রের কাছে গিয়ে বসলেন নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর তাঁর কাছে গান শোনার আবদার করলেন। যুবক তন্ময় হয়ে গাইতে শুরু করলেন,
মন চল নিজ নিকেতনে।
সংসার-বিদেশে বিদেশীর বেশে ভ্রম কেন অকারণে।
বিষয়পঞ্চক আর ভূতগণ,
সব তোর পর, কেহ নয় আপন,
পরপ্রেমে কেন হয়ে অচেতন
ভুলিছ আপন জনে।
ঠাকুর যেন চিনতে পারছেন তাঁর আপনজনকে। এঁর জন্যেই তো অপেক্ষা করে ছিলেন তিনি। কতদিন কেটে গেছে পথ চেয়ে আর কাল গুণে। অবশেষে দেখা হল। গান শেষে হলে নরেন্দ্রনাথকে উত্তরের বারান্দায় টেনে নিয়ে গেলেন তিনি। চোখ দিয়ে দরদর করে ঝরছে আনন্দাশ্রু। যুবক নরেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, আড়ালে তাঁকে বুঝি কিছু উপদেশ দেবেন ঠাকুর। কিন্তু তা করছেন কই! তিনি যে তাঁকে দেখছেন আর কাঁদছেন! ঠাকুরের হেন ব্যবহারের কোনও অর্থই যে বুঝে উঠতে পারছেন না নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর কাঁদতে কাঁদতে তাঁর হাত ধরে বলছেন, এতদিন পরে তবে আসতে হয়? আমি যে এতদিন কী করে অপেক্ষা করে থেকেছি সে শুধু আমিই জানি; বিষয়ী লোকের কথা শুনে শুনে কান ঝলসে যাবার জোগাড়। ঠাকুর কাঁদছেন আর বলে চলেছেন, প্রাণের কথা কাকে বলব! পেট যে কথা কইতে না পেরে ফুলে গেল! ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে তখন বিস্ময়াবিষ্ট যুবক নরেন্দ্রনাথ! এসব কী হচ্ছে তাঁর সঙ্গে? দক্ষিণেশ্বরের এই ঠাকুর তাঁকে কী বলছেন? কেনই বা বলছেন? নরেন্দ্রনাথের যুক্তি-বুদ্ধি যেন গঙ্গার স্রোতে ভেসে যায় যায়! ঠাকুর ইতিমধ্যে তাঁর সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। যেন নরেন্দ্রনাথ দেবতার মূর্তি। আর ঠাকুর তাঁর ভক্ত। সেইভাবে দাঁড়িয়ে ঠাকুর উচ্চারণ করলেন সেই অমোঘ কথাটি; বললেন, ‘জানি আমি প্রভু, তুমি সেই পুরাতন ঋষি, নররূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি নিবারণ করিতে পুনরায় শরীরধারণ করিয়াছ’।
আরও শুনুন: অবতার বলেই গিরিশের বকলমা নিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
সেই পুরাতন ঋষিই তো নেমে এসেছিলেন ধরাধামে। ঠাকুর তাঁকে চিনেছিলেন সেদিন, সেই দ্বিতীয় সাক্ষাতে। জগৎ তাঁকে চিনেছিল আর কটাদিন পরে। যখন বিবেকানন্দের গৈরিক শিখা জাতির ভিতর জাগিয়ে দেবে মন্যষ্যত্বের স্ফূরণ। তাঁর অপূর্ব প্রাণনে জেগে উঠবে নতুন এক ভারতবর্ষ। এক অনন্ত যাত্রাপথের সূচনা হল সেদিন। যুবক নরেন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন, মন চল নিজ নিকেতনে।/ সংসার-বিদেশে বিদেশীর বেশে ভ্রম কেন অকারণে। এ কী কেবলই কাকতালীয় ঘটনা! আকস্মিকের খেলা! নাকি যুগের অভিসন্ধি এসে মিলিয়ে দিয়েছিল দুজনকে! শুরু হয়েছিল এক অনন্ত যাত্রা! বিস্মিত ভারতবাসী আজও সেদিকে তাকিয়ে থাকে। চিনতে পারে তার নিজ নিকেতনকে।
আমাদের সকলকেই একদিন না একদিন এসে দাঁড়াতে হয় রামকৃষ্ণ স্টেশনে। সেখান থেকে আমাদের সকলেরই গন্তব্য হয় বিবেকানন্দধামে।