ভক্তদের মনের ছোটখাটো ইচ্ছেও পূরণ করতেন মা সারদা। কোনও সন্তান যাতে নিরানন্দ না হন, মুখের হাসিটি যাতে বজায় থাকে, সে জন্য সব ক্লেশ সহ্য করতেন। তবে এই সবকিছুর ভিতর একটাই লক্ষ্য ছিল তাঁর, তা হল – জগতের বৃহত্তর হিতসাধন। সেখান থেকে একটা দিনও একটুও সরে যাননি তিনি। একবার এক চিকিৎসকের স্ত্রীর প্রার্থনা আর মায়ের জবাবেই ধরা পড়েছিল সেই লোকহিতের বড় কথাটি। আসুন শুনে নিই সেই গল্প।
মায়ের কাছে কেউ কিছু চাইল, আর সে তা না পেয়ে খালি হাতে ফিরে গেল, এমনটা সচরাচর হয় না। ছেলেদের জন্য মা সদাসর্বদা দরাজহস্ত। যার যা কিছু চাওয়া হাসিমুখে পূরণ করছেন। সামান্য জিনিস, ছোট ছোট জিনিসেও যে আনন্দ লুকিয়ে থাকে, সেটুকুকেই যে উপভোগ করতে হয় – তাই-ই যেন নিজের কাজে বুঝিয়ে দিচ্ছেন সকলকে। মার তো কোনও কিছুতেই ‘না’ নেই। একজন গরিব ভক্ত মায়ের জন্য সামান্য শাকসব্জি এনে মনে মনে ভাবছেন, এ জিনিস কি মাকে দেওয়া যায়! কত লোক কত ভালো ভালো জিনিস আনছেন মায়ের জন্য! সেখানে এই সামান্য জিনিসের কী বা দাম! তবু সংকোচ নিয়েই যেই না সেই সব মায়ের হাতে তুলে দিয়েছেন, অমনি মায়ের সে কী আনন্দ! হোক না সামান্য জিনিস, তাতে কী! আর মায়ের আনন্দ দেখে ভক্তের মুখেও ফুটে উঠল হাসি। এই মুখের হাসিটুকুই তো মা দেখতে চান। আর-এক ভক্ত মায়ের জন্য এনেছেন মোটা সুতোর কাপড়! তারও একই সংকোচ। কিন্তু যেই না মাকে কাপড়খানা দিলেন, অমনি মা কাপড় গ্রহণ করে আনন্দের সঙ্গে বললেন, ‘বাবা, এই আমার গরদ, ক্ষীরোদ, নীরদ।’ মা বলতেন, ‘জিনিসের কী আর দাম! যে দেয় তার প্রাণের টান, ভক্তিই তো দেখতে হয়।’
আরও শুনুন – তিনি লক্ষ্মী আবার তিনিই সরস্বতী, মায়ের কাছেই অনন্ত ঐশ্বর্যের খোঁজ
ভক্তের প্রাণের টানে মা বাঁধা। বারেবারেই তার প্রমাণ মিলেছে। তখন ঠাকুরের তিরোধান হয়েছে। একদিন এক ভক্ত মায়ের জন্য চালের পিঠে তৈরি করে নিয়ে যাচ্ছেন। একজন তাঁকে মনে করিয়ে দিলেন, মা তো ব্রাহ্মণের বিধবা, রাতে চালের জিনিস মুখে দেবেন না। কিন্তু এই সব সংস্কার থেকে মা যে কত দূরে, কতখানি ঊর্ধ্বে অচিরেই তার প্রমাণ মিলল। ভক্ত যখন মায়ের কাছে পৌঁছলেন তখন সন্ধে হয় হয়। সসংকোচে পিঠে ক-টি মায়ের হাতে তুলে দিলেন, আর তাঁর আশঙ্কার কথা জানালেন। মা সব শুনে বললেন, ‘বাবা! মুখে দেব বইকি! তুমি এতদূর থেকে বয়ে নিয়ে এসছ, কত কষ্ট করে তৈরি করিয়েছ … রাত্রে ঠাকুরকে দিয়ে মুখে দেব, তুমি এ নিয়ে চিন্তা কোর না। ‘ মা তাই বলতেন, ‘ছেলেদের কল্যাণের জন্য আমি সব করতে পারি।’
আরও শুনুন: ঠাকুর বলতেন, সত্যনিষ্ঠা থাকলে জগদম্বা বেচালে পা পড়তে দেন না…
কিন্তু এই ‘সব করতে পারা’র অর্থ কি যে কোনও দাবি মেনে নেওয়া! ভক্তের মুখে হাসি ফোটাতে, অনেককে কষ্ট দেওয়া! না, তা কখনই নয়। এই বিচারে মা খুবই কড়া। যা জগতের হিতের জন্য নয়, এমন কাজে তাঁর ছিটেফোঁটাও প্রশ্রয় ছিল না। একবার এক মহিলা ভক্ত মায়ের কাছে একটি আবদার করলেন। তাঁর স্বামী চিকিৎসক। ভক্তের আরজি, স্বামীর যেন উপার্জন বৃদ্ধি হয়। কিন্তু এই আশীর্বাদ যদি করেন মা, তবে তো অনেকের অসুখ হতে হবে; তবে চিকিৎসকের উপার্জন বাড়বে। মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘এমন আশীর্বাদ করব আমি – লোকের অসুখ হোক, কষ্ট পাক? তা তো আমি পারব না মা! সব ভাল থাকুক, জগতের মঙ্গল হোক।’
এইটেই ছিল মায়ের ব্রত। ঠাকুর বলে গিয়েছিলেন, শিবের মতো করে জীবের সেবা করার কথা। মা-ও বলেন সেই কথাটিই। বলেন, ‘মা জগদম্বে, জগতের কল্যাণ করো।’