ঠাকুর বলতেন, মা সারদা হলেন স্বয়ং সরস্বতী। এসেছেন, সকলকে জ্ঞান বিতরণ করতে। আবার যাঁরা মায়ের চারপাশে ছিলেন, তাঁরা জানতেন, মা যেন স্বয়ং বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী। একইসঙ্গে শ্রী অর্থাৎ সৌন্দর্য আর জ্ঞানের অপূর্ব মিলন মূর্তি হলেন শ্রী শ্রী মা সারদা। আসুন আমরা আজ শুনে নিই মায়ের কথা। তাঁর এই দুই রূপ উপলব্ধি করি।
কল্পতরু হয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যখন ধরা দিলেন ভক্তদের মাঝে, তখন হাটে হাঁড়িটি ভেঙে দিয়ে গেলেন ঠাকুর। বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, যিনি রাম, যিনি কৃষ্ণ, তিনিই এসেছিলেন এ যুগে রামকৃষ্ণ হয়ে। ঠাকুরের সেই অপরূপ লীলার সাক্ষী থাকল গোটা বিশ্ব। এদিকে ঠাকুরের লীলার পাশে পাশেই তো বয়ে চলেছে আর এল লীলামাধুরীর অপূর্ব স্রোত। সে লীলা শ্রীশ্রী মায়ের। তিনিও তো কোনও কিছুই প্রকাশ করেন না। আড়াল করে রাখেন নিজেকে।
আরও শুনুন – ভারতমাতা তাঁকে গ্রহণ করেছিলেন আপন সন্তানরূপে, অনুভব নিবেদিতার
কিন্তু ভক্তেরা তাঁকে ঠিকই চিনেছেন। ঠাকুর বলতেন মা হলেন স্বয়ং সরস্বতী। আর ভক্তেরা তাঁকে চিনলেন, সাক্ষাৎ লক্ষ্মী হিসেবে। ভক্তেরা জানেন, মা যেমন রুচিসুন্দর মনের অধিকারী, তেমনই গুছিয়ে সব কাজ করতে ভালোবাসেন। মা স্নেহশীলা। আবার এই প্রাত্যহিক কাজকর্মের মধ্য দিয়েই তিনি একটু একটু করে শিখিয়ে দেন ঈশ্বরাভিমুখী হওয়ার প্রক্রিয়া। সংসার, সৌন্দর্য,জ্ঞান, প্রজ্ঞা, আধ্যাত্মিকতা, আধুনিকতার- এমন সম্মিলন আগে কেউ কখনও দেখেননি। তবে এইসবকিছু তিনি লুকিয়ে রেখেছেন। সবার আগে তিনি মা, সকলের মা।
আরও শুনুন: ঠাকুর বলতেন, সত্যনিষ্ঠা থাকলে জগদম্বা বেচালে পা পড়তে দেন না…
ভক্তদের জন্য বরাবরই প্রাণ কাঁদে মায়ের। একসময় তিনি নিজে হাতে পাতা ধুয়ে, কাপড় দিয়ে মুছে তবে ভক্তদের প্রসাদ দিতেন। আসন আর পাতা যেন ঠিক ঠিক বসে, টেরাবাঁকা না হয়- সেদিকেও ছিল মায়ের নজর। একবার জয়রামবাটীতে গেছেন গিরিশ ঘোষ। দেখেন রোজই তাঁর বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় ধবধব করছে। একেবারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তিনি কলকাতার মানুষ। গ্রামঘরে এমন পরিষ্কার কীভাবে হচ্ছে ভেবে কূল পান না। শেষে একদিন দেখেন, মা নিজের হাতে প্রতিদিন তাঁর চাদর সাবান দিয়ে কেচে দিচ্ছেন। এই স্নেহ ঐশ্বরিক। এই স্নেহ শুধু মায়ের কাছেই মেলে। ঠাকুরের কাছে ছিল জগতের আনন্দের খোঁজ। আর মা যেন উজাড় করে দিছেন তাঁর স্নেহের ভাঁড়ার। ওই জয়রামবাটীতেই মায়ের বাড়িতে উঠোনে ইটের টুকরো, খোলামকুচি ইত্যদি পড়ে থাকে। ভক্তেরা খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করে। পাছে কারও আঘাত লাগে, এই আশঙ্কায় মা রাত থাকতে উঠে লন্ঠন জ্বেলে সেই সব পাথর, ইট পরিষ্কার করে সরিয়ে রাখতেন। একদিন জনৈক ভক্ত-সন্তান তা আবিষ্কার করে বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন, মা এত রাত্তিরে এসব কী করছ তুমি? মা শুধু বলেন, ও কিছু না।
আরও শুনুন: মানুষ কি নিজের মন্দ কাজের ভারও ঈশ্বরের উপর চাপাতে পারে?
এই হলেন মা সারদা। তাঁর অপার স্নেহ, করুণাধারায় স্নাত ভক্তেরা, তাঁর সন্তানেরা। আবার এই মা-ই তো ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে বলেছিলেন, ঠাকুর এলেন আর দুদিনের জন্য আনন্দ করে লীলা করে চলে গেলেন- তা হবে না। ঠাকুরের নাম নিয়ে যারা ঘর ছাড়ল, তাঁরা কি পথে পথে ভিক্ষে করে খাবে! মা হয়ে সন্তানের এই দশা তিনি দেখতে পারবেন না। ঠাকুরের কাছে তাই তাঁর প্রার্থনা, ভক্তদের যেন মোটা ভাত কাপড়ের অভাব না হয়। তারা যেন ঠাকুরের নাম নিয়ে, ভাব-উপদেশ নিয়ে একত্রে এক জায়গায় থাকতে পারে। এই ভাবনাই তো পরবর্তীকালে জন্ম দিয়েছে রামকৃষ্ণ সংঘের। তাই তো তিনি সংঘজননী। একাধারে তাই তিনি লক্ষ্মী এবং সরস্বতী। অপ্রকাশের লীলায় নিজেকে প্রকাশ করেননি কখনও। তবু তাঁর পায়ের ছাপ যেন আলপনা হয়ে আঁকা আছে সর্বত্রই।