একবার ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করা হল, আপনার কি জাতিভেদ আছে? ঠাকুর বললেন, কই আর আছে? কেশব সেনের বাড়ি চচ্চড়ি খেয়েছি। তবু একদিনের কথা বলছি। একটা লোক লম্বা দাড়িওয়ালা – বরফ নিয়ে এসেছিল , তা কেমন খেতে ইচ্ছে করল না। আবার একটু পরে একজন তারই কাছ থেকে বরফ নিয়ে এল, ক্যাচর ম্যাচর করে চিবিয়ে খেয়ে ফেললাম। তা জানো, জাতিভেদ আপনি খসে যায়।
ঠাকুরের অলৌকিক শক্তির পরিচয় পেয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ। তবে সকলেরই যে সৌভাগ্য হয়েছিল তা নয়। ঠাকুর তো নিজেকে লুকিয়েই রাখতেন। অলৌকিকত্বের সবরকম প্রকাশ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতেন সচেতন ভাবে। কেবলমাত্র নরেন্দ্রনাথের সামনেই তাঁর প্রকাশ ছিল একেবারে অন্যরকম।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৪): অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, বুঝলেন নরেন্দ্রনাথ
এই যে ঠাকুর নিজেকে আড়াল করে রাখতেন, এর কারণও আছে। ঠাকুরের পূর্ব জীবনের দিকে তাকালে তাঁর হদিশ মেলে। যে সময় ঠাকুর নিজেকে প্রকাশ করছেন, প্রচার করছেন ধর্ম সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মত – সেই সময়টাই ছিল বেশ অদ্ভুত। বাংলার ধর্মসাধনার স্রোতে তখন বিরুদ্ধমতের সংঘর্ষ। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের গোঁড়ামি একদিক থেকে সমাজকে আচ্ছন্ন করেছে। ঠাকুরের নিজের ব্যবহারেও গোড়ার দিকে তার কিছু কিছু প্রকাশ দেখা দিয়েছে। শোনা যায়, রানি রাসমণি যেদিন দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঠাকুর। তখন অবশ্য তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংস নামে পরিচিত হননি। তিনি তখন গদাধর চট্টোপাধ্যায়। দাদা রামকুমারের মধ্যস্থতায় রানিমার মন্দির প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। রামকুমার নিজে পৌরহিত্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। গদাধর সেদিন সেখানে উপস্থিত থেকেও কোনওরকম খাবার ছুঁয়ে দেখেননি। সময়ের সংস্কার তখনও তার মধ্যে কিছু থেকে গিয়েছিল।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৩): ঠাকুরের স্পর্শে আচ্ছন্ন নরেন্দ্রনাথ… মা ভাবলেন, ছেলে বুঝি বাঁচবে না!
আবার এর একটা উলটো দিকও আছে। দেখা যায়, গদাধর যখন একেবারে ছোট, তখন উপনয়নের সময়ই বালক গদাধর প্রথা ভেঙেছিলেন। উপনয়নের সময় সাধারণত ব্রাহ্মণ বালকের মাতাই ভিক্ষাদান করেন। সেই সময় তিনদিন বালক শূদ্রের মুখদর্শন করেন না। এই ছিল নিয়ম। কিন্তু সেই পুরোহিততন্ত্রের নিয়ম গদাধরের উপনয়ন কালে খাটেনি। গদাধর ভিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন এক কামার মহিলার কাছে। এই যে দুই বিপরীত ধারণার প্রকাশ – এ যেন সময়েরই চরিত্র। এমনকী উপবীত শরীরে রাখা নিয়েও ঠাকুর কোনও নিয়ম মানেননি। কখনও শরীরের বন্ধন ভেবে উপবীত ফেলে দিয়েছেন। আবার তাঁর ভাগনে হৃদয় যত্ন করে তা পরিয়ে দিয়েছেন। ঠাকুর পরবর্তীকালে তাঁর ভক্তদের যে উপদেশ বা নির্দেশ দিচ্ছেন, তাতেও দেখা যায় সংস্কারকে তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন না। আবার কিছু কিছু নিয়ম বেশ করে মানতে বলছেন। এমনকী জাতিভেদ নিয়েও তাঁর যে মত ছিল সেই সময়ে, তা-ও বেশ বিস্ময়কর। একবার ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করা হল, আপনার কি জাতিভেদ আছে? ঠাকুর বললেন, কই আর আছে? কেশব সেনের বাড়ি চচ্চড়ি খেয়েছি। তবু একদিনের কথা বলছি। একটা লোক লম্বা দাড়িওয়ালা – বরফ নিয়ে এসেছিল , তা কেমন খেতে ইচ্ছে করল না। আবার একটু পরে একজন তারই কাছ থেকে বরফ নিয়ে এল, ক্যাচর ম্যাচর করে চিবিয়ে খেয়ে ফেললাম। তা জানো, জাতিভেদ আপনি খসে যায়। যেমন নারকেল গাছ, তালগাছ বড় হয়, বেল্লোত আপনি খসে পরে! জাতিভেদ তেমনই খসে যায়! টেনে ছিঁড়ো না।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১২): ঠাকুরের সঙ্গেও তর্ক করতেও ছাড়তেন না যুবক নরেন্দ্রনাথ
এই যে কথাটা ঠাকুর বলেছিলেন, তা থেকে দুটো জিনিস স্পষ্ট হয়। এক, জোরাজুরি করে কোনও মত বা পথ বিশ্বাস করাতে হবে – এমন জুলুম ঠাকুরের পছন্দ নয়। সারা জীবনের সাধনার পরে তবেই তাঁর এই উপলব্ধি হয়েছিল। তাই তো তিনি জগতকে দিয়ে যাবেন সেই মহামন্ত্র- যত মত তো পথ। এ শুধু ঠাকুরের কথার কথা তো ছিল না। নিজের জীবন দিয়েই এই সত্য তিনি পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় কথাটি হল, সময়। নারকেল গাছ বড় হলে তবে বেল্লোত খসে পড়ে। আমরা ধারণা করতে পারি, গোড়ায় সংস্কার হয়তো তাঁরও কিছু ছিল। কিন্তু সাধনার পথে ঠাকুর যত এগিয়েছেন, তত খসে গিয়েছে সব সংস্কারের বেল্লোত। তাঁর সাধনপদ্ধতিও যে খুব প্রথাগত ছিল, তা নয়। ঠাকুর নিজের মতো করে সাধনায় প্রবৃত্ত হয়ে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। ফলত হিন্দুরা এযাবৎ ঠিক যেমন সাধু চিনত, ঠাকুর তেমনটি নন। তাঁর আলাদা করে কোনও ধর্মমত নেই। কোনও পৃথক ধর্মসম্প্রদায়ের জন্ম তিনি দেননি। তিনি সকল ধর্মেই মুক্তির পথ খুঁজেছিলেন।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১১): অন্য ভক্তদের সঙ্গে তর্ক করুক নরেন্দ্রনাথ, এ যেন ছিল ঠাকুরেরও ইচ্ছা
আমরা যদি ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই শেষভাগটির দিকে তাকিয়ে দেখি, তবে বুঝব ঠাকুর যেন যুগের প্রয়োজনেই এই নতুন পথটি খুঁজছিলেন। ঠাকুর তাই অলৌকিকত্ব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সিদ্ধাই প্রকাশ ও গুরুগিরি নিয়ে ছিল তার ঘোরতর আপত্তি। এমন সাধক সেই সময়ে আর কেউ দেখেননি। স্বয়ং কেশবচন্দ সেন তাকে পরমহংস বলে অভিহিত করেছিলেন। এই ব্যতিক্রমী সাধক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল সেদিনের যুক্তিবাদী যুবক নরেন্দ্রনাথের। আর ঠাকুরও চিনেছিলেন নরেন্দ্রনাথের আধার। তাই ঠাকুর আর নরেন্দ্রনাথের ভিতর যে ভাবের আদান-প্রদান তা সবার থেকে আলাদা। আর পাঁচটি ঘটনার সঙ্গে তাকে কখনোই এক করে মেলানো যায় না।