পুজোর চাঁদা চাওয়ার ব্যাপারটা এক-একসময় রীতিমতো উৎপাতের চেহারা ধরে। কিন্তু কী করবেন, এখন তো আর পেটন সাহেব নেই! চাঁদা নিয়ে গুণ্ডামিকে যিনি শায়েস্তা করে ফেলতেন অনায়াসে! এমনকি তার জন্য একবার মেয়ের ছদ্মবেশ ধরেছিলেন সেই সাহেব!
দুর্গাপুজোর ঢাকে কাঠি। বাঙালির মনে এখন উৎসবের মরশুম। যতই করোনার কাঁটা খচখচ করুক, বছরকার উৎসবে সাধ্যমতো শখ আহ্লাদ তো মেটাতে হবেই। সুতরাং একদিকে পকেটে টান, আরেকদিকে জামা-জুতো-এটা-সেটার লম্বা ফর্দ। এই দুইয়ের টাগ অফ ওয়ারে ব্যালান্স করে চলতে চলতেই হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় আরেক বিল। পুজোর চাঁদা। হ্যাঁ, পুজো এলেই মধ্যবিত্ত বাঙালির বুক ধড়ফড় শুরু। কে জানে, এবার কত টাকা ধার্য হল! পাড়ার পুজোর আনন্দের মাঝে এ যেন এক সাজা।
কথা হচ্ছে, চাঁদার শুরুয়াত কিন্তু ইদানীং কালে হয়নি। আদ্যিকাল থেকেই রমরমিয়ে চলছে চাঁদা সংস্কৃতি। বাংলায় গোড়ার দিকে দুর্গাপুজো হত কেবল বনেদি বাড়িগুলোতেই। সেগুলো একেবারেই পারিবারিক পুজো। বাইরের লোক নিতান্তই দর্শক। কিন্তু এই দর্শকেরা যখন ভাবল, নিজেদের মতো করে পুজো করলে কেমন হয়, তখন থেকেই চাঁদা চাওয়ার উৎপত্তি। অনেকেই তো ট্যাঁকখালির জমিদার। চারদিন ধরে একটা পুজো চালানোর মতো রেস্ত আসবে কোথা থেকে! তা তাতে আর চিন্তা কী! সেই যে গৌতম বুদ্ধের ভিক্ষুণী বলেছিলেন, ‘আমার ভাণ্ডার আছে ভরে/ তোমা সবাকার ঘরে ঘরে’। সেই কথাকেই বেদবাক্য মেনে শুরু হয়ে গেল ‘বারো-ইয়ারি’ বা বারোয়ারি পুজো। আর তার সঙ্গেই শুরু হল চাঁদা চাওয়ার রেওয়াজ। অনেক সময়েই আবেদন-নিবেদনের গণ্ডি ছাড়িয়ে রীতিমত জুলুমে পর্যবসিত হত এই চাঁদা সংস্কৃতি।
তবে একবার আচ্ছা শায়েস্তা হয়েছিলেন এই জুলুমবাজ চাঁদা আদায়কারীরা। তখন ইংরেজ পুলিশের আমল। নিজেরা যাই করুক, নেটিভদের শাস্তি দিতে তারা সবসময় একপায়ে খাড়া। বেহালার বারোয়ারিতলার সামনে দিয়ে তখন লোকের পথ চলা দায়। কারণ সেই চাঁদার উপদ্রব। উৎপাত করত খোদ সাবর্ণ চৌধুরীদের বাড়ির ছেলেরা। যে পরিবার কলকাতার মালিক ছিল কদিন আগেও, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে কে! ফলে জুলুম চলছিলই। এমনকি মহিলাদেরও রেহাই ছিল না।
তার প্রতিকার করতে পথে নেমেছিলেন এক ইংরেজ সাহেব। কী ঘটেছিল তারপর, সে কথা জানাচ্ছেন শ্রীপান্থ-
১৮৪০ সালের কথা। কলকাতা থেকে একখানা পালকি চলেছে বেহালার দিকে। সুন্দর দামি পালকি। চার পাশে ভেলভেটের ঘেরাটোপ। নীচে রেশমি ঝালর। ‘হেঁইয়া হো, হেঁইয়া হো’ করতে করতে ছুটে চলেছে চারটে জোয়ান বেহারা। দেখতে দেখতে পালকি এসে পৌঁছল বেহালা। সাবর্ণ চৌধুরীদের বিরাট বাড়িটা ডাইনে রেখে বেহারারা বাঁয়ের পথ ধরল। বাঁয়ে বারোয়ারিতলা। বারোয়ারিতলাতে যেমনি পা দেওয়া, অমনি পিছন থেকে হুকুম এল, থামাও পালকি।
হুকুমদার একদল যুবক। পালকি দেখেই আন্দাজ, ভিতরে নিশ্চয়ই কোনও বড় ঘরের বধূ রয়েছেন। টাকা না দিলে পালকি ছাড়া যাবে না, এমনটাই তাদের দাবি। শাসানো গলায় হুকুম দিলেন, তোদের বধূকে বের কর, তাঁর সঙ্গে টাকাপয়সা আছে কি না আমরা দেখব। বেহারারা আপত্তি করায় একসঙ্গে চারদিক থেকে ঘেরাটোপে তাদের নির্লজ্জ উদ্ধত হাত পড়ল। কিন্তু ভেলভেটের আবরণখানা উঠতেই চোখের বাতিগুলো যেন এক ফুঁয়ে নিভে গেল ওদের। পালকিতে শাড়ি-পরা বউটির মুখের দিকে তাকিয়ে কারও চিনতে অসুবিধে হল না যে, ইনি দুর্ধর্ষ পেটন সাহেব। চব্বিশ পরগনার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পেটন। নারীর বেশ ছেড়ে স্বমূর্তি ধরলেন সাহেব, তারপর জনাকয়েককে ধরে নিয়ে দিলেন কড়া শাস্তি। এরপর থেকে আর এই চাঁদার জুলুমের কথাও শোনা যায়নি।