ভাইফোঁটা মানে কেবল ফোঁটা দেওয়া বা যমের সঙ্গে দ্বন্দ্বই নয়। একসময় শহর কলকাতা তো বটেই, মফস্সল বাংলাতেও ভাইফোঁটার দিন চিত্রগুপ্তের পুজো হত আড়ম্বরে। কিন্তু হঠাৎ করে চিত্রগুপ্ত পুজো পেলেন কেন? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
যমের দুয়ারে কাঁটা দিতেই বাংলার ঘরে ঘরে ভাইকে ফোঁটা দেন বোনেরা। ভবিষ্যপুরাণ আবার যমদ্বিতীয়া তিথিতে বোনের রাঁধা ভাত খাওয়ার বিধান দিয়েছে, তাহলেই নাকি বাড়বে ভাইয়ের আয়ু। প্রতিপদে যাঁদের ফোঁটা দেওয়ার নিয়ম, তাঁরা তো মন্ত্রেই বলেন, ‘প্রতিপদে দিয়া ফোঁটা/ দ্বিতীয়াতে দিয়া নিতা’। নিতা অর্থ এখানে নেওতা বা নিমন্ত্রণ। তবে জানেন কি, ভাইফোঁটা মানে কেবল ফোঁটা দেওয়া বা যমের সঙ্গে দ্বন্দ্বই নয়। সেদিনই যমের সহচর চিত্রগুপ্তকে পুজো করাও ছিল বাঙালির প্রাচীন প্রথা।
নাহ, বর্তমান বাংলায় কোথাও ভাইফোঁটার দিন যম বা চিত্রগুপ্তের পুজো হয় না। কিন্তু একসময় শহর কলকাতা তো বটেই, মফস্সল বাংলাতেও ভাইফোঁটার দিন আড়ম্বরে চিত্রগুপ্তের পুজো হত। আর এই পুজোর মূল উদ্যোক্তা ছিল ‘বঙ্গদেশীয় কায়স্থ সভা’।
কিন্তু হঠাৎ করে চিত্রগুপ্ত পুজো পেলেন কেন? তার ইতিহাস খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, ১৯০১ সালে বাংলার জনগণনা হয়, সেইসঙ্গেই বাঙালিদের নানা জাতের সামাজিক অবস্থানের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন ব্রিটিশ সরকারের আধিকারিক রিজলি। সেই রিপোর্টে দেখা গেল, অন্যান্য জাতিদের নিরিখে কায়স্থদের সামাজিক অবস্থান ছয় নম্বরে। এর প্রতিবাদে সেই বছরেই তৈরি হয়েছিল ‘বঙ্গদেশীয় কায়স্থ সভা’। আর কৌলীন্য আদায়ের তাগিদে তাঁরাই শুরু করলেন চিত্রগুপ্তের পুজো। এর আগেই, ১২৮৫ বঙ্গাব্দে ‘কায়স্থ পুরাণ’-এর লেখক শশীভূষণ নন্দীবর্মা ভবিষ্যপুরাণের উদ্ধৃতি দেখিয়ে লিখেছিলেন, ‘কার্ত্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে কায়স্থদিগের চিত্রগুপ্তের অর্চ্চনা করা কর্ত্তব্য।’ ব্রহ্মার কায়া থেকে চিত্রগুপ্তের উৎপত্তি এবং তাঁর বংশধরেরা কায়স্থ নামেই পরিচিত, এমনটাই প্রতিষ্ঠা করল কায়স্থ সভা। ১৯৫১ সালে এই সভার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ‘শ্রীশ্রী চিত্রগুপ্তদেবের পূজা’ সাড়ম্বরে করার প্রস্তাব উঠল, এমনকি প্রস্তাব এসেছিল চিত্রগুপ্তের মন্দির তৈরি করারও। সে বছর শোভাবাজারের দেব বাড়িতে সভার অধিবেশন বসেছিল। আর সভার মাঝে ছিল ‘কায়স্থ জাতির আদি পিতা শ্রীশ্রী চিত্রগুপ্তদেবের একখানি বৃহৎ তৈলচিত্র’।
সেবারই কায়স্থ সভার মুখপত্র কায়স্থ পত্রিকা জানায়, কালীঘাটের বাসিন্দা মাখনলাল ভাগবতভূষণের বাড়িতে প্রতিবছর ভাইফোঁটার দিন চিত্রগুপ্তের পুজো হয়ে আসছে। কলকাতায় কোন কোন অভিজাত বাড়িতে, এবং মফস্সলেও কোথায় কোথায় চিত্রগুপ্তের পুজো হয়েছে, তার খতিয়ান দিয়েছিল এ পত্রিকা। জানা যাচ্ছে, রাজশাহী কায়স্থ সমিতিও প্রতি বছর ভাইফোঁটার দিন চিত্রগুপ্ত পুজোর আয়োজন করত। তা ছাড়া আরামবাগ, দিনাজপুর, এমন একাধিক জায়গায় পুজোর হদিশ মিলছে।
জাতিগৌরব প্রতিষ্ঠার তাগিদেই যে এহেন অভিনব প্রথার জন্ম, তা তো বোঝাই যায়। তবে বাংলার স্বভাবে সবকিছুকেই আত্মস্থ করে নেওয়ার এক অদ্ভুত প্রবণতা রয়েছে। আর সেই প্রবণতার জেরেই ভাইফোঁটার পাশাপাশি চিত্রগুপ্তের পুজোও সহাবস্থান করেছে এ বাংলায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পুরনো প্রথা হারিয়ে গিয়েছে বটে, তবে তার গল্পেরা এখনও ভেসে বেড়ায় বাংলার পুরনো ইতিহাসের পাতায়।
[ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক]