মাতৃপক্ষ। মায়ের কাছেই সকল চাওয়া। চোখ বন্ধ করে। খোলা চোখে অবশ্য অপ্রাপ্তি। বিস্তর। মা আর মেয়েদের পাওনার ঘরে ঘরে আজও মস্ত ঢ্যাঁড়া। সেই কথা নতুন করে বলাই হোক এবারের অঞ্জলি মন্ত্রে। হয়তো এ অন্যরকম, অথবা এ-ই স্বাভাবিক।
দেবীপক্ষে মায়ের কাছে মেয়েদের নিরাপত্তা চাইলেন প্রহেলী ধর চৌধুরী। পড়ে শোনাচ্ছেন, চৈতালী বক্সী। অলংকরণে দীপঙ্কর ভৌমিক।
পুজোর ঠিক আগের ম্যান্ডেটরি হোম ক্লিনিং চলছে। স্টাডিরুমের খাতা, বই, তাক সব ঝেড়েঝুড়ে, হালকা সাবান জল স্প্রে করে শ্বেতপাথরের দুর্গামূর্তিটাকে সবে মুছতে গেছি। মূর্তিটা বলে উঠল, ‘হ্যাঁচ্ছো!’
তারপর চোখ বুজে, ভুরু-টুরু কুঁচকে পরিষ্কার বাংলায় বলল;
— নাকের ভেতর সাবান জল ছেটাস কেন রে গবেট?
— বাবা গো, মা গো, কুট্টিমাসি গো…
চিৎকার করে দশ হাত দূরে ছিটকে পড়লাম আমি। পাথরের দুর্গা অমনি টুক করে বইয়ের তাক থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। দুহাত কোমরে দিয়ে সটান সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
— দামড়া বয়সে কথায় কথায় মা-মাসিকে টানিস, এই বুকের পাটা নিয়ে করবি রাত দখল?
আমি খানিক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু পরক্ষণেই পার্সোনাল ভয়ের থেকে পাবলিক প্রেস্টিজের ম্যাটারটা বেশি ইম্পরট্যান্ট মনে হওয়ায় গলা খাঁকরানি দিয়ে বললাম,
— কই কই, ভয় পাইনি তো। দিনের বেলা ঘুম না-হলে আমার চোখে একটু ঝিলিমিলি লেগে যায় কিনা, তাই পাথরের মূর্তিতে প্রাণ এসে যাওয়ার ট্রাঞ্জিশন মোমেন্টটা ঠিক ঠাওর করতে পারিনি আর কি।
— উঃ, ন্যাকা! বছর বছর যখন প্যান্ডেলে গিয়ে ‘মাগো পাশ করিয়ে দাও গো, পরেরবার ফার্স্ট হয়ে দেখাব’; ‘মাগো প্রমোশন পাইয়ে দাও গো, প্রতি সোমবার নিরামিষ খাব’; ‘মাগো বয়ফ্রেন্ডের সাথে প্যাচ-আপ করিয়ে দাও গো, ওকে বিয়ে করার ব্যাপারটা সিরিয়াস কন্সিডারেশনে রাখব’… এসব গুচ্ছ গুচ্ছ সলিড ঢপবাজির কমিটমেন্ট করিস, তখন তো নেগোসিয়েশনের বহর দেখে মনে হয় না যে প্রাণহীন মূর্তির সাথে লেনদেনের হিসেব কষছিস।
— আস্তে আস্তে। আরে এ কী বিপদ! এসব গোপন চাহিদার কথা এমন চেঁচামেচি করে বলতে আছে নাকি!
— কী ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মাইরি! যা চাইবি তা বলবি না, আর যা বলবি তা চাইবি না। সত্যি মাইরি!
আমি কাঁচুমাচু মুখে বললাম,
— ইয়ে মানে… সেকেন্ড অ্যালিগেশনটা এক্সট্রা হয়ে গেল না ঠাকুর?
— এক্সট্রা? কী বলছিস! তোরা যা বলিস তাই চাস? দুদিন আগে বললি দুর্গোৎসব ক্যান্সেল। আমিও ভাবলাম, যাক, লেটে হলেও শুভবুদ্ধি টুকি দিয়েছে। তাপ্পর বললি, না না উৎসব হবে না, কিন্তু পুজো হবে; নইলে ঢাকিরা, খুচরো ব্যবসায়ীরা সারাবছরের জন্যে লোকসানে পড়বে। এমন পুজোনির্ভর অর্থনীতি দেখে হেসে কুল পাইনে, তবু তোদের ফেলো-ফিলিংটাকে শারদসম্মান দিয়ে ব্যাপারটা আমি অ্যাকসেপ্ট করেছিলুম। তারপর দেখি সব বানানো বাতেলা। ঢাকি হায়ার করার বদলে সাউন্ড বক্স দিয়ে থ্রিডি ব্যাকগ্রাউন্ডওলা ঢাক বাজাচ্ছে। পাড়ার দোকানের বদলে শপিং মল থেকে জামা কিনছে, রাস্তার রোলের বদলে রেস্টুরেন্টে গিয়ে থাই স্যুপ খাচ্ছে, আন্ডাবাচ্চা বগলদবা করে সেই তৃতীয়া থেকে রাত জেগে ঠাকুর দেখছে… বলি ভগবানের নামে এমন ভেজাল সংস্কৃতি চালাতে লজ্জা করে না তোদের?
ডিফেন্সে কিছু একটা বলা দরকার। মাথা চুলকে বললাম,
— মানে কথাটা ঠিকই আছে, তবে কিনা ওরা মনে হয় ব্যতিক্রম… মানে পলিটিশিয়ান-ফলিটিশিয়ান হবে বোধহয়।
— এই চোপ। একদম পলিটিশিয়ানদের ঘাড় দিয়ে সব চালাবি না। পলিটিক্সটা কেউ স্যালারি নিয়ে করে, আর যারা সেটাও জোটাতে পারে না, তারা এমনি এমনি করে। আর বাকি হাতে গোনা যে-কজন জেনুইনলি কাজের কাজটা করার চেষ্টা করে, তারা তোদের মতো দাতব্য পলিটিশিয়ানদের জন্যে আল্টিমেটলি কিছুই করে উঠতে পারে না।
— আহা তা কেন, আমাদের জেনুইন কতগুলো দাবি আছে তো।
— বটে? তা সে কি এখন বলা যাবে, নাকি পোলিটব্যুরোর সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় থাকতে হবে?
আমি গলা ঝেড়ে বললাম,
— আরে না না, আমরা বুড়ো পার্টিরও নই, আবার বুড়ো হঠিয়ে ছুঁড়ো লাও পার্টিরও নই। আমদের দলের নাম হল— বদল।
— অ্যাঁ?
— হ্যাঁ। বদলা নয়, বদল লাও/ সব মেয়েদের সেফটি দাও। এই হল আমাদের স্লোগান।
হাহাহিহিহোহো… আমার কথা শুনে ঠাকুরের সে কী হাসি। জেনারেলি অমন ভুবনমোহিনী হাসি দেখলে আমার মন দিলরুবা হয়ে যায় আর আমি ঝুপ্পুস প্রেমে পড়ে যাই। কিন্তু স্ট্যান্ডপয়েন্ট থিয়োরিতে কার্ল মার্ক্স ঠিকই বলেছিলেন, সবই ডিপেন্ড করে নিজের পাওয়ার পজিশনের ওপর। তাই হাসির পাত্রটি নিজে হলে, অমন জগন্মোহিনী হাসিও যাচ্ছেতাই রকমের জঘন্য লাগে, সেকথা বুঝতে সময় লাগল না।
বললাম,
— হাসছ? সিরিয়াসলি? আর জি কর, জয়নগর আর পূর্ব মেদিনীপুরের এমন নৃশংস ধর্ষণ-খুনের ঘটনার আবহেও মেয়েদের সেফটির প্রশ্নে তুমি হাসছ?
— হাসব না? শুধু কি ক্যাতুকুতু দিলেই হাসি পায় নাকি? আজব দাবি তো!
তারপর জানলা দিয়ে উদাসী চোখে আকাশপানে তাকিয়ে হাত দিয়ে চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে ঠাকুর বলল, — হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী পড়ে হাসি পায়, একুশে আইন আর হযবরল পড়লে হাসি পায় আবার মর্ত্যের এমন কাণ্ড দেখেও হাসি পায়।
পাছে আমায় এক্ষুনি একুশে আইন আবৃত্তি করতে বলা হয় আর আমি তুতলে যাই, তাই মনে মনে কবিতাটা সবে ঝালাতে শুরু করেছি, অমনি ঠাকুর দুম করে প্রশ্ন করল;
— মেয়েরা সবথেকে আনসেফ কোন জায়গায়?
দেখেছ! জীবনে কোনও দিন সিলেবাসের মধ্যে থেকে প্রশ্ন আসবে না গো! কত কষ্ট করে সেই কবেকার একুশে আইন মনে করছিলাম, আর তার মধ্যে…
— কী হল, উত্তর দিচ্ছিস না যে? মেয়েরা সবথেকে আনসেফ থাকে কোথায়?
ঠাকুর আবার জিজ্ঞেস করল।
কী গেরো মাইরি। মনে পড়ল, কদিন আগে একটা রিপোর্টে পড়েছিলাম যে এ দেশের মেয়েরা সবথেকে বেশি আনসেফ নিজের বাড়িতেই। কিন্তু আর জি কর, জয়নগর কিংবা মেদিনীপুরের ঘটনার পর সেই উত্তর কি আর ভ্যালিড আছে? কী যে বলি এখন…
কথায় বলে ভগবান পাশে থাকলে সবই উপায় হয়। তা ভগবান পাশে বসে ছিল বলেই কি না জানি না, হঠাৎই ফেসবুকের এক বন্ধুর একটা পোস্ট মনে পড়ল। আননোন টেকনিক্যাল প্রশ্নকে ফিলোজফিক্যালি অ্যানসার করে উতরে যাওয়ার পন্থা বাতলানো ছিল তাতে। আমি সেইমতো প্রথমে ভুরু কুঁচকে কপালে হালকা দু-এক ভাঁজ ফেললাম, মুখটা গম্ভীর করে ঠাকুরের মুকুটসহ মাথার ওপর দিয়ে দৃষ্টিটাকে আলগোছে শূন্যে ভাসিয়ে দিলাম। তারপর গম্ভীর মুখে সেই মহাশূন্যের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলাম।
মা দুর্গা হঠাৎই কেমন যেন নরম হয়ে গেলেন; পিঠের ওপর হাত রেখে বললেন,
— ঠিকই বলেছিস। সর্বত্র।
মাইরি ভগবানকেও গোল খাইয়ে দিলাম যে! আমি কি তবে সিসিফাসের থেকেও ধড়িবাজ? ওগো দান্তে, তোমার কোনিকাল নরক স্ট্রাকচারের শেষবিন্দুতে ব্রুটাসের পাশেও যে আমার আর জায়গা হবে না গো…
নরক টেনশনে যখন আমার গলদঘর্ম অবস্থা, উদ্ধার করলেন স্বয়ং দুর্গাঠাকুরই। বললেন,
— শোন,
স্বর্গ হোক বা মর্ত,
সর্বত্র আছে শর্ত।
চাইলে পাবে না কিছু,
যতই নাও না লোকের পিছু।
বললাম,
— খেয়েছে। কিন্তু মেয়েদের সেফটিটা এই মুহূর্তে যে বড্ড দরকার গো ঠাকুর। অন্য কেউ না দিক, তুমি অন্তত একটা ব্যবস্থা করো…
— উফ, চাইতে চাইতে আর বিনামূল্যে পেতে পেতে এমন হ্যাবিট হয়েছে এদের, যে, ভোট ছাড়া নিজেদের দেওয়ারও আর কিছু নেই, করেকম্মে পাওয়ারও বিশ্বাস নেই। হোপলেস। যাই হোক, একটা ছড়া শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছি, সকলকে বলে দিবি। দেখবি ইমান্সিপেশনের সব তত্ত্ব ওতেই বলা আছে। ওকে?
বললাম,
—ওক্কে। দাঁড়াও, নোট নিই।
ঠাকুর তখন বললে,
— লেখ,
লড়াই গোটাটা হয় নিজেদেরই মনে,
প্রতি স্থান, প্রতি ক্ষণ, জন প্রতি জনে।
লড়াই জিততে হয় সাহসের জোরে,
জনমত লড়লে রাত থেকে ভোরে।
“মেয়েদের সেফটি চাই”, চাইছ কার কাছে?
নিজের মধ্যেই যখন মা-দুর্গাটি আছে?
ত্রিনয়ন সংসারে ডোনেশন দিয়ে,
সব দায়, সব কাজ, একা কাঁধে নিয়ে,
বল মেয়ে, বল দেখি কী পেলি তুই কবে?
চেয়েছিস কোনও কিছু, যে, কিছু তোর হবে?
আজ থেকে দাবি কর নিজের ইচ্ছে,
ওই দেখ জীবন কেমন ডাক দিচ্ছে।
আজ থেকে কেটে যাক সোসাইটির ভয়,
ভয় মাইনাস হলেই জয় শুধু জয়।
শিখে নে মার্শাল, ক্যারাটে আর ফাইট,
দখল নে দুর্গম, দিন কিংবা নাইট।
মনে রাখিস সবখানে, সবটুকু, তোর,
তোকে আমি বানিয়েছি, তুই আমার জোর।
— যারা যারা দুর্গাপুজোর অঞ্জলি দেবেন মণ্ডপের সামনে এগিয়ে আসুন…
মাইকে পুরোহিত মশাইয়ের গলার আওয়াজে চোখ খুলল।
পুরোহিতমশাই কি জানেন, আমার অঞ্জলি অলরেডি হয়ে গিয়েছে?