উৎসব হোক, কিন্তু উৎসবের জন্য দীর্ঘ ছুটির কী প্রয়োজন? এই যুক্তিতেই উঠেছিল পুজোর ছুটি বাতিলের প্রস্তাব। কী হল তারপর? শুনেই নিন।
দুর্গাপুজোর টানা ছুটি নিয়ে আপত্তি উঠেছিল অনেকদিন আগেই। সেই ইংরেজ আমলেই। কলকাতা সেসময় ভারতের রাজধানী, ফলে দুর্গাপুজো তখন কেবল বাংলার উৎসব নয়, সর্বভারতীয় উৎসব। তাই সারা দেশ জুড়েই সেসময় পুজোর ছুটি থাকত। কিন্তু বাংলার বাইরে অন্য মানুষেরা, যাঁরা এই পুজোয় শামিল নন, তাঁরা এই দীর্ঘ ছুটিকে কাজের ব্যাঘাত বলেই মনে করতেন। তাই ইংরেজ সরকারের কাছে পরের পর আর্জি জমা পড়ছিল, যাতে এই ছুটি কমিয়ে দেওয়া হয়।
১৮৩৫ সালের ১০ অক্টোবর ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে এমনই এক খবর:
“দুর্গোৎসবোপলক্ষে যে ছুটি বঙ্গদেশীয় লোকেরা কোন প্রকারে উপেক্ষা করিতে ইচ্ছুক নহেন ঐ ছুটিতে পশ্চিম দেশীয় লোকেরদের অত্যন্ত ক্লেশ হয় যেহেতুক তাহাতে সর্বপ্রকার কর্মই নিরর্থক স্থগিত হয়।”
এ প্রসঙ্গে পত্রিকা এ কথাও জানাচ্ছে যে, কিছুদিন আগে তাবত সরকারি দপ্তরে ছুটি কমানোর কথা উঠেছিল। কিন্তু বাঙালিদের তুমুল বিরোধিতায় সেই প্রস্তাব কার্যকর করা যায়নি। এমনকি পরবর্তী কালে সরকারের তরফে শেষ পর্যন্ত এমন আপস রফাও করতে হয় যে, জরুরি কাজের জন্য বিশেষ বিশেষ সরকারি দপ্তর খোলা থাকবে। তবে এই সময়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজগুলিই মাত্র সারা হবে। আর সম্ভব হলে হিন্দু কর্মীদের ছুটি দিয়ে অন্যান্য কর্মীদের দিয়ে সেই কাজ সামলে নেওয়াই বাঞ্ছনীয়।
শুধু সরকারি অফিসই নয়, বেসরকারি ক্ষেত্রেও ছুটি কমানোর প্রস্তাব উঠেছিল সে আমলে। এমনিতে পুজো উপলক্ষে যে পত্রিকার কার্যালয়ও বন্ধ থাকত, সে কথা জানাচ্ছে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার এক খবর। ১৮৫২ সালের ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত সে খবর জানিয়েছিল, পুজোর ছুটিতে পত্রিকা কোন কোন দিন বন্ধ থাকবে। কিন্তু অনেক পত্রিকার সম্পাদকেরা সেই প্রচলিত পুজোর ছুটি বন্ধ করে কর্মীদের দিয়ে কাজ করানোর চেষ্টা করেছিলেন। ১৮৬৩ সালের ১২ অক্টোবর ‘সোমপ্রকাশ’ যেমন জানাচ্ছে, “সোমপ্রকাশের জন্ম অবধি দুর্গোৎসব উপলক্ষে সোমপ্রকাশ দুই সপ্তাহ করিয়া বন্ধ হইয়া আসিতেছে। এবারে বন্ধ করিবার কোনক্রমেই ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কর্মচারিদিগের নিতান্ত অসন্তোষ দেখিয়া অগত্যা দুই সপ্তাহকাল বন্ধ করিতে হইল।”
আসলে বাঙালির থোড়-বড়ি-খাড়া জীবনে পুজোর ছুটিই বরাবরের খোলা হাওয়া। সেকালেও কেরানি বাঙালি যতরকম আপসই করুক না কেন, ছুটির ব্যাপারে না-পাওয়া মেনে নিতে রাজি ছিল না। আর তার ফলেই, ছুটি কমানো বা বন্ধ হওয়ার প্রস্তাব শুরুতেই থেমে গিয়েছে সেকালে।