দেবী দুর্গার বাহন কে? সহজ উত্তর, সিংহ। পাড়ার প্যান্ডেল হোক কিংবা পুরনো রাজবাড়ি, দেবীর সনাতনি মূর্তিতে সিংহের দেখা মিলবেই। এক পা মহিষাসুরের উপর রেখে জগজ্জননী দেবী দুর্গার বাহন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন পশুরাজ সিংহ। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় এক কেশরহীন সিংহের দেখা মেলে। তার মুখ আবার ঘোড়ার মতো। এমন বাহনের কী বিশেষত্ব জানেন? আসুন শুনে নিই।
“দেবী সজ্জিতা হলেন অপূরপ রণচণ্ডী মূর্তিতে,
হিমাচল দিলেন সিংহ বাহন, বিষ্ণু দিলেন চক্র, পিনাকপাণি শংকর দিলেন শূল…”
মহালয়ার ভোর আসতে এখনও কয়েকদিন বাকি। তবু এই শ্লোক শুনলে মনে বেজে ওঠে আগমনীর সুর। কিন্তু এতবড় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানের ঠিক এইদুটো শ্লোক নিয়ে হঠাৎ কেন কথা বলছি? কারণটা দেবীর বাহন, সিংহ। সাধারণত দেবী মূর্তিতে যে সিংহ দেখা যায়, তার বাস জঙ্গলে। তবে চিড়িয়াখানা কিংবা অভয়ারণ্যে গেলে সাধারণ মানুষও সেই প্রাণীকে স্বচক্ষে দেখতে পারেন। কেশর ফুলিয়ে গর্জন ছাড়লে তাঁকে রাজা বলে মেনে নিতে অস্বীকার করবেন না কেউই। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবীর অসুরবধের যে বর্ণনা মেলে, সেখানেও সিংহরাজের ভূমিকা যথেষ্টই। তবে কিছু কিছু দেবী মূর্তিতে সিংহের এই পরিচিত রূপটির দেখা মেলে না। সেখানে দেবীর বাহন ঘোড়ামুখের এক সিংহ।
আরও শুনুন:
দে মল্লিক বাড়িতে এখনও পূজিতা হন রাজা হর্ষবর্ধনের কুলদেবী
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঘোড়া আর সিংহ এক হল কীভাবে?
শাস্ত্রে এই বাহনের বিশেষ কোনও ব্যাখ্যা নেই বললেই চলে। তবে এ বিষয়ে কিছু প্রচলিত কাহিনি রয়েছে। কলকাতার বেশকিছু বনেদী বাড়িতে সিংহের এই বিশেষ রূপটি চোখে পড়ে। যার মধ্যে শোভাবাজার বাজবাড়ি অন্যতম। তবে শুধু কলকাতা নয়, কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে দেবী দুর্গার যে মূর্তি পূজিতা হন, তার বাহনও ঘোটকমুখী।
শোনা যায়, আঠারো শতকে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর বাড়ির দুর্গা পুজোয় নতুন এক রীতির প্রচলন করেন। মহালয়ায় পুজো শুরু করতেন তিনি, আর সেদিন থেকেই চলত যজ্ঞ। একেবারে নবমীর দিন সেই যজ্ঞ সমাপ্ত হত। দেবী সেখানে রাজরাজেশ্বরী রূপে পূজিতা হত্ন। তিনিই পরমাপ্রকৃতি আদিশক্তির প্রতীক। সেই কারণেই তিনি যোদ্ধাবেশী। এবার যুদ্ধের সঙ্গে ঘোড়ার সম্পর্ক রয়েইছে। তাই মনে করা হয়, মহারাজের বাড়ির দেবী মূর্তিতে দেবীর বাহন ঘোটকমুখী। এখনও রাজবাড়িতে একচালায় যোদ্ধা দেবীর পুজো হয়। তবে এরসঙ্গে প্রচলিত রয়েছে শাক্ত-বৈষ্ণবের উপাখ্যানও। সেই গল্পে অবশ্য বারোয়ারী পুজোর উল্লেখ মেলে।
আরও শুনুন:
সনাতনী মাতৃরূপ থেকে থিমের দুর্গা… যুগের সঙ্গে কীভাবে বদলেছে দেবীর মূর্তি?
সালটা সম্ভবত ১৮২৬। সেবার চুঁচুড়ায় শুরু হল বারোয়ারি পুজো। পুজোর শুরুতেই শাক্ত আর বৈষ্ণবদের রীতিমতো গোল বাঁধল। কোন মতে পুজো হবে, সেই নিয়েই শুরু হল ঝামেলা। শেষমেশ ঠিক হল দুই রীতিতে পূজিতা হবেন দেবী। একইমূর্তি একবার শাক্তরা পুজো করবেন, তারপর পুজো করবেন বৈষ্ণবরা। তাই হল। কিন্তু বিসর্জনের সময় ফের সমস্যা। বৈষ্ণবরা বলল, তাদের ঘট বিসর্জন হয়ে গিয়েছে। তাই প্রতিমা বির্সজনের খরচ দেবে না। এদিকে শাক্তরাও পালটা দাবি তুলল খরচ নিয়ে।
যেহেতু বারোয়ারী তাই সবমিলিয়ে চরমে পৌঁছাল বিবাদ। যাইহোক কোনওক্রমে সে বছরের মতো মাতৃপ্রতিমা জলে পড়লেন। কিন্তু পরেরবার আলাদা মূর্তি গড়ে দুই আলাদা রীতিতে পুজো হবে তাই ঠিক হল। কিন্তু সেখানেও দুই মূর্তি এক হলে সমস্যা। তাই মূর্তিতে বাহনে আনা হল বদল। বৈষ্ণবদের দেবী মূর্তিতে বাহন হিসেবে রাখা হল এই ঘোটকমুখী সিংহকে। আর শাক্তদের ক্ষেত্রে চিরাচরিত সিংহ-ই বহাল থাকল। এর থেকেই প্রচলিত হল সিংহের ওই বিশেষরূও। যা এখনও বিভিন্ন বাড়ির দেবী মূর্তিতেই দেখা যায়।