নবমী নিশি বড় মনখারাপের। পুজো শেষের মন খারাপ। ছুটি ফুরোনোর মন খারাপ। তবে নবমী সন্ধ্যার একটা বিষয় সব মন খারাপ ভুলিয়ে দিতে পারে। ঠিক ধরেছেন, সন্ধ্যারতি ঢাকের তালে ধুনুচি নাচের কথাই বলছি। কীভাবে দুর্গাপুজোর অবিচ্ছেদ্য অংশ হল এই ধুনুচি নাচ? আসুন শুনে নেয়া যাক।
ধুনুচি নাচ। বাঙালির একেবারে নিজস্ব বলতে যা কিছু, তার অন্যতম। অবাঙালিদের মধ্যেও এর চল রয়েছে। তবে বাঙালির সঙ্গে ধুনুচি নাচের সম্পর্ক চিরন্তন। শাস্ত্রমতেই পুজোতে ধুনো জ্বালানো নিয়ম। তবে ধুনুচি হাতে বাঙালিকে নাচতে দেখা যায় দুর্গাপুজোতেই। বাড়ির পুজো তো বটেই, বারোয়ারী পুজোতেও ঘটা করে ধুনুচি নাচের আয়োজন করা হয়।
আসলে, দুর্গাপুজো মানে স্রেফ ধর্মীয় নিয়ম পালন নয়। এ হল বাঙালির আবেগের উৎসব। আর সেই উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ধুনুচি নাচ। নাচের ধরণ তেমন আলাদা কিছু নয়। তবে নির্দিষ্ট কোনও গানের ছন্দে নয়, নাচতে হবে ঢাকের তালে তালে। আরতির সময় মায়ের সামনে ধুনুচি হাতে নাচ শুরু। একেবারে আরতি শেষ হওয়া পর্যন্ত চলবে নাচ। ছেলে মেয়ে সকলেই তাতে অংশ নিতে পারেন। নাচের নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যে যার নিজের মনের আনন্দে কোমর দোলান। তবে প্রচলিত কিছু কায়দা আছে। এই যেমন, দুই হাতে দুটো ধুনুচি নিয়ে নাচ করা। অনেকে আবার দাঁতে করে ধরে রাখেন আরও একটা ধুনুচি। তবে জলন্ত ধুনুচিই যে নিতে হবে এর কোনও মানে নেই। বিপদ এড়াতে অনেকে স্রেফ ধুনো বিহীন ধুনুচি নিয়ে নাচ শুরু করেন। তাতে আগুন ছিটকে পড়ার ভয় থাকে না। অনেক জায়গায় একসঙ্গে অনেকে মিলে এই নাচ করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাঙালির উৎসবের সঙ্গে এই নাচ জুড়ল কীভাবে?
নেপথ্যে সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন। তবে অনেকেই দেবীর সঙ্গে এর যোগ খুঁজে পান। পুরাণের কাহিনির সূত্র ধরে দুর্গাপুজোয় ধুনুচি নাচের যোগ টানে কেউ কেউ। ব্যাপারটা খানিকটা এরকম- দেবী মূর্তিতে যে অসুরকে দেখা যায় তিনি আসলে অসুররাজ মহিষাসুর। দেবীর বরেই মূর্তিতে তাঁর ঠাঁই হয়েছে। তবে এই মহিষাসুরকে কাবু করা এত সহজ ছিল না। প্রবল পরাক্রমশালী অসুর দেবীকে যুদ্ধে আহ্বান করেছিলেন। হয়েওছিল ভীষণ যুদ্ধ। দেবী মাহাত্ম্যে সে বর্ণ্না মেলে। তবে স্রেফ যুদ্ধ নয়, দেবী রণচণ্ডী মূর্তিতে মহিষাসুরের সামনে নাচ করেছিলেন বলেও অনেকে দাবি করেন। পুরাণের সেই কাহিনিতেই উল্লেখ মেলে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি নিয়ে অসুর রাজের সামনে দেবীর প্রলয়নৃত্যের কথা। যে কেউ দেবীর সেই রূপ দেখে ভয় পাবেন। আগুন নিয়ে এই নাচই আসলে ধুনুচি নাচ। দেবীর অসুর বধের মুহূর্ত কল্পনা করেই মণ্ডপে ধুনুচি হাতে নাচ করেন ভক্তরা। তবে গোটাটাই প্রচলিত কাহিনি। সকলেই যে একে মান্যতা দেন এমনটা একেবারেই নয়। অনেকে মনে করেন, ধুনুচি নাচ বাঙালির ঐতিহ্য। সেই হিসাবে দুর্গাপুজোর সঙ্গে এর যোগ তৈরি হয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন ধুনুচি নাচ বাংলার লোক শিল্পের অংশ। তবে নেপথ্যের কারণ যাই হোক, ধুনুচি নাচ আসলে যে উন্মাদনা তৈরি করে তার জুড়ি মেলা ভার। তাই প্রতিবছর নিয়ম করে মায়ের সামনে ধুনুচি নাচ করতে হাজির হন অনেকে। বিসর্জনেও এমনটা করতে দেখা যায়। আনন্দ উদযাপনে অন্য মাত্র এনে দেয় এই ধুনুচি নাচ।