দেবীর ভোগ রাঁধে মুসলিম পরিবার। এমনটা না হলে পুজো অসম্পূর্ণ থাকে। শুধু তাই নয়, প্রতিবছর পুজোর আগে গ্রামের কোনও মুসলমান ব্যক্তি দেবীকে স্বপ্নে দেখেন। এই গ্রামের পুজোয় বছরের পর বছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। কোন পুজোর কথা বলছি? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
দুর্গাপুজো হিন্দু উৎসব। ভিনধর্মের কেউ তাতে শামিল হলেও সরাসরি দেবীর পুজোর অংশ নেন না। ব্যতিক্রম রঘুনাথগঞ্জের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজো। ব্রাহ্মণ বাড়ির পুজো হলেও, এখানে দেবীর ভোগ রাঁধেন মুসলমান। ভিনধর্মীর ভোগেই তুষ্ট হন দেবী।
আরও শুনুন:
অনুদান নেই, চাঁদাও না পেলে পুজো হবে কী করে! উপায় বাতলে দিল লটারি
দুর্গাপুজোর আবহে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির নজির দেখা মেলে এই পুজোয়। তাও আবার বারোয়ারি নয়, বাড়ির পুজোয়। জানা যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়রা একসময় এখানকার জমিদার ছিলেন। তাদের আদি বাড়ি ছিল সাগরদিঘির মণিগ্রামে। বহুকাল আগে চলে আসেন রঘুনাথগঞ্জ দু’নম্বর ব্লকের জোতকমল গ্রাম পঞ্চায়েতের লক্ষ্মীজনার্দনপুর বহুরা গ্রামে। গ্রাম তখন ঘন জঙ্গলে ঘেরা। তাতে ডাকাতরাই দেবী দুর্গার পুজো করতেন। গ্রামে আর কোনও পুজো সেইসময় হত বলে জানা যায় না। একদিন কাজের তদারক সেরে জমিদার শরৎচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। সেইসময় ডাকাতদের দেবী দুর্গার মূর্তি দেখতে পান। কথিত আছে, সেই রাতেই জমিদার শরৎচন্দ্রকে স্বপ্নাদেশ দেন দেবী। তাঁর বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হতে চান তিনি। দেবীর আদেশে জঙ্গল থেকে ডাকাতদের পূজিত দেবী দুর্গার মূর্তি নিয়ে আসা হয় বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে। বাড়িতে দেবীকে প্রতিষ্ঠিত করে পুজো শুরু হয়। কিন্তু সে পুজোয় দেবী সন্তুষ্ট হননি। বিশেষ কারণে তিনি তৃপ্ত নন। কিংবদন্তি, স্বপ্নেই সেকথা জানান দেবী। বলেন, কোনও মুসলিম পরিবারের মহিলার হাতের ভোগ চান তিনি। এমন স্বপ্নাদেশ পেয়ে বেজায় ঘাবড়ে যান জমিদার।
আরও শুনুন:
ঠাঁই নেই নস্টালজিয়ার! পুজো আসছে, তবে ট্রামের মতোই হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার চালচিত্র
সমস্যার সমাধান করেন দেবী নিজেই। সেই সময় বহুরা গ্রামে বাস করতেন এক বিধবা মুসলমান মহিলা। তিনি সকলের কাছে লোকাইয়ের মা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। জমিদার শরৎচন্দ্র সেই মহিলার শরণাপন্ন হন। তাঁকেই দায়িত্ব দেন দেবীর ভোগ রাঁধার। কিন্তু দারিদ্রতার কারণে মুসলিম মহিলা তা প্রত্যাখ্যান করেন। শোনা যায়, সেই রাতে দেবী দুর্গার স্বপ্নাদেশে পান লোকাইয়ের মা। তাঁর হাতে কোদার নাড়ু খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন দেবী। দেবীর ইচ্ছা পূরণে ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে কোদার খুঁদ সংগ্রহ করে নাড়ু তৈরি করে লোকাইয়ের মা। মুসলিম রমণীর তৈরি ভোগ নিবেদন করা হয় দেবীকে। সেই নিয়ম আজও মানা হয় নিষ্ঠা ভরে। দেবীকে প্রথম ভোগ নিবেদন করেন গ্রামের কোনও মুসলিম মহিলাই। আশ্চর্যভাবে গ্রামের কোনও না কোনও মুসলিমকে স্বপ্নে দেখা দেন দেবী। ঠিক বোধনের আগের দিন এমন কাণ্ড ঘটে। কোদার নাড়ু খেতে চেয়েছিলেন দেবী, সেই কারণে স্থানীয়রা এই পুজোকে কোদাখাকি দুর্গার পুজো বলে থাকেন। এছাড়া আরও অনেক নিয়ম রয়েছে এই পুজোর। যেমন এই পুজোতে আরতি ও পুষ্পাঞ্জলি হয় না। তবে ডাকাতদের শুরু করা পুজোয় পাঁঠা বলির চল রয়েছে। স্রেফ হিন্দু নয়, পুজোর কটাদিন সব সম্প্রদায়ের মানুষ কোদাখাকি দুর্গাকে ঘিরে উন্মাদনায় মেতে ওঠেন। প্রকৃত অর্থেই হিন্দু মুসলিম সৌভ্রাতৃত্বের ছবি স্পষ্ট হয় এই পুজোয়।