বিশ্বনাথ মোতিলাল বাড়ির পুজো নামে পরিচিত যে পুজো, তা শুরু হয়েছিল প্রায় ১৭৭৯ সালে। কিন্তু সে পুজো বিশ্বনাথ মোতিলাল শুরু করেননি। তাহলে কীভাবে এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে গেল তাঁর নাম। তাহলে খুলেই বলা যাক সেই গল্প।
সে উনিশ শতকের কথা। বিয়ে লেগেছে বাড়িতে। টাকার অভাব নেই, ধুমধামেরও শেষ নেই। কিন্তু দায়িত্ব নেবে কে! তাই গৃহস্বামী দুর্গা পিতুরি চিঠি লিখলেন ভাগ্নে বিশ্বনাথ মোতিলালকে। জানালেন, ‘তোমার বোন হরসুন্দরীর বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে। সামনের অঘ্রানের শুরুতেই। নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করতে তো তোমায় আসতে হবেই, তাছাড়া তুমি যদি এখনই এখানে এসে বিয়ের অনুষ্ঠানের দায়িত্ব বুঝে নাও, তবে আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত হই। আমার বয়স হয়েছে। এখন আর সবটা একা হাতে সামলানোর সাহস পাচ্ছি না।’ মামার চিঠি পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেলেন যুবক বিশ্বনাথ। তাঁর আদি বাড়ি জয়নগরে। সেখান থেকেই পড়াশোনা করেছেন একরকম, কিন্তু চাকরি খুঁজতে গেলে তো কলকাতায় আসা ছাড়া গতি নেই। এদিকে মামা দুর্গাচরণ পিতুরি হলেন গিয়ে ইংরেজদের শেরিফ দফতরের মুৎসুদ্দি। ব্রিটিশ প্রভুদের অধীনে কাজ করে তাঁর এখন মেলাই ধনদৌলত। একমাত্র মেয়ে হরসুন্দরীর বিয়ে ঠিক করেছেন দেওয়ানজী বাড়িতে। আর সেই বিয়ে উপলক্ষেই তিনি নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন বিশ্বনাথকে। এই সূত্রে কলকাতায় একবার গিয়ে পড়লে কাজ খোঁজারও সুযোগ হয়ে যাবে, মনে করলেন বিশ্বনাথ। আর তাই, চিঠির উত্তর পাঠানোর জন্য আর সময় নষ্ট করলেন না তিনি। সোজা ব্যাগ-বাক্স সমেত, কলকাতার দুর্গা পিতুরি লেনের মামাবাড়িতে গিয়ে উঠলেন। আর তারপর বিয়ের যথাবিহিত দায়িত্বও সামলে দিলেন ভালোভাবেই। আর এই বিয়েতেই ঘটল একটা কাণ্ড। জাঁকজমক করে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার পর যখন কন্যাবিদায়ের পালা, দুর্গা পিতুরি ছলছল চোখে তাঁর বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত কুলদেবীর অষ্টধাতুর মা-করুণাময়ীর মূর্তি, মেয়ের হাতে তুলে দিলেন। যেন একমাত্র সন্তানের সঙ্গে বিচ্ছেদের মুহূর্তে নিজেকে স্তোক দিতেই, মেয়েকে বললেন, ‘আজ থেকে ইনি তোকে রক্ষা করবেন। এঁকে যত্ন করিস। কখনও কাছছাড়া করিসনে মা।’
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: দে মল্লিক বাড়িতে এখনও পূজিতা হন রাজা হর্ষবর্ধনের কুলদেবী
দুর্গা পিতুরির বাড়ির কুলদেবীর মূর্তিতে কালী ও জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় চারটি ও দুর্গাপুজোর সময় দশটি হাত জুড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তিনি মেয়ের সঙ্গে চলে যাওয়ায়, দুর্গা পিতুরির বাড়িতে মাটির প্রতিমা পুজো শুরু হল। এদিকে বিয়ে শেষ হওয়ার পরেও ভাগ্নে বিশ্বনাথ রয়ে গেলেন মামাবাড়িতেই। সেখানে থেকেই চাকরি খুঁজতে খুঁজতে মিলেও গেল একটা কাজ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লবণের গোলায় মাসিক ৮ টাকা বেতনের চাকরি পেলেন তিনি। এবার তো আর মামাবাড়িতে পড়ে থাকা শোভন দেখায় না। তাই কাছাকাছি জেলেপাড়া অঞ্চলে ভাড়া নেওয়ার জন্য বাড়ি খুঁজতে লাগলেন। মামা দুর্গা পিতুরির কানে এই কথা গেলে তিনি বিশ্বনাথকে ডেকে পাঠালেন। আজকাল খুবই ব্যস্ত থাকেন বিশ্বনাথ। একই বাড়িতে থাকলেও রোজ দেখা হয় না মামার সঙ্গে। তবে ডাক পেয়ে তিনি গেলেন। দুর্গা পিতুরি সটান জিজ্ঞেস করে বসলেন, এ বাড়িতে থাকতে কি তোমার সমস্যা হচ্ছে বিশ্বনাথ? বিশ্বনাথ এমন প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলেন না। কী বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। তাঁকে চুপ থাকতে দেখে দুর্গা পিতুরি বলেন, ‘বিশ্বনাথ, তুমি চলে গেলে আমার এই বাড়ি, এই সম্পত্তির কী হবে? আমার তো আর কোনও সন্তান নেই! এ বাড়ি তোমার। তুমি এখানেই থাকবে। কালই আমি উকিল ডেকে সমস্ত লেখাপড়া করে দিচ্ছি, তুমি অমত কোরো না।’ বিশ্বনাথের কোনও ওজরই খাটল না মামার ওপর। তবে মামার সম্পত্তি পেলেও, তাকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছিলেন তিনি। কলকাতার ইতিহাস ঘাঁটলে ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধের বঙ্গীয় সমাজের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবেই বিশ্বনাথ মোতিলালের নাম পাওয়া যায়। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লবণের গোলায় মাসিক ৮ টাকা বেতনে কাজ শুরু করে, ধীরে ধীরে পদোন্নতি করে একসময় সেখানকার দেওয়ান হন। শোনা যায়, মৃত্যুর সময় প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা নগদ রেখে গিয়েছিলেন তিনি। কলকাতার লালবাজার ও বৈঠকখানার মাঝের এলাকা, তিনি তাঁর এক পুত্রবধূকে দান করেছিলেন। সেই থেকে ওই এলাকা, বৌবাজার নামে খ্যাত।
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: গণেশজননী বা অসুরদলনী নন, শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে দুর্গার আরও যে রূপগুলির
মামা দুর্গা পিতুরির সম্পত্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বাড়ির পুজোর দায়িত্বও বর্তেছিল বিশ্বনাথের উপরেই। দুর্গা পিতুরির পর, ক্রমে ক্রমে তা বিশ্বনাথ মোতিলালের পুজো বলেই চিহ্নিত হয়ে যায়। তবে এ বাড়ির পুজোতে বেশ কিছু বিশেষত্ব ছিল। পরিবারের বিশ্বাস, মহাকাল নিজে বাহনরূপে থাকেন দেবীর সঙ্গে, সাদা রঙের ঘোড়ামুখী সিংহরূপে। এখানে পুজো হত শাক্তমতে। ষষ্ঠীতে বোধনের পর, সপ্তমী থেকে নবমী দেবীর জন্য রোজ মাছ ভোগ দেওয়া হত। তবে শিবের জন্য শুধু চালের নৈবেদ্য বরাদ্দ ছিল। নিয়ম ছিল, বাইরের মিষ্টি দিয়ে পুজো হবে না। বাড়িতে তৈরি মিষ্টি, গুড়ের পাক দেওয়া ৪০টি নারকেল দিয়ে তৈরি নাড়ু দিয়েই হত পুজো। আর বিসর্জনের পর, পরিবারের সকলে মিলে খেতেন পান্তাভাতের সঙ্গে আগের দিনের রান্না করা, কচুশাক, ডাল সেদ্ধ, ইলিশ মাছ ভাজা আর পায়েস। প্রায় ২৪০ বছর ধরে এইসব নিয়ম নিষ্ঠা মেনেই পুজো হয়ে এসেছে এ বাড়িতে। অবশেষে কোভিড হানার দরুন ইতি পড়ে গিয়েছে কলকাতার এই বনেদি বাড়ির পুজোয়।