অভয়া থেকে অসুরদলনী। নানা রূপে পূজা পান দুর্গা। তবে সন্তানসন্ততির সঙ্গে মায়ের যে রূপটি বাংলায় আমাদের চিরচেনা, তার উৎপত্তি হল কেমন করে? মহিষমর্দিনী দেবীর প্রতিমার সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গেলেন তাঁর সন্তান-সন্ততিরা? জানালেন সৌভিক রায়।
মহিষাসুরকে বধ করে স্বর্গ রক্ষা করলেন দেবী দুর্গা। সেই মহিষাসুরমর্দিনীর আবাহনেই দুর্গাপূজা করে বাংলা। তবে মা দুর্গা কি কেবল অসুরদলনী? তা তো নয়। বাংলায় কোথাও কোথাও তিনি হরগৌরী মূর্তিতে পূজিতা হন। চিরাচরিত সিংহবাহিনী রূপ ছেড়ে দেবী ষণ্ডের পৃষ্ঠে আরোহণ করেন, তাঁর ক্রোড়ে বসেন শিব। আবার কোথাও তিনি অভয়া মূর্তিতেও পূজিতা হন। এমন বহু ক্ষেত্রেই মহিষাসুর অনুপস্থিত। কিন্তু দেবীর সঙ্গে থাকেন তাঁর সন্তানেরা। বঙ্গে দুর্গাপুজোর প্রচলনকারীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন রাজা কংসনারায়ণ, তিনিও পুত্র-কন্যা সহ দুর্গার পুজো করেছিলেন।
মহিষমর্দিনী দেবীর প্রতিমার সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গেলেন তাঁর সন্তান-সন্ততিরা?
প্রথমেই বরং শুনে নেওয়া যাক মহামায়ার জন্মকথা। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে রয়েছে, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও অন্যান্য দেবতাদের তেজ মিলিত হয়ে মহামায়ার আবির্ভাব হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল মহিষাসুরের সংহার। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে কোথাও লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশের উল্লেখ নেই। রামচন্দ্রও অকালবোধনে কেবল মহিষাসুরমর্দিনীর পুজো করেছিলেন।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের তিন চরিতে দেবী যথাক্রমে মধু-কৈটভ, মহিষাসুর ও শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করেছিলেন। শিবের আরাধনা করে মহিষাসুরের জন্ম হয়েছিল। কাত্যায়ন মুনির কোপে পড়া মহিষাসুর আগেই স্বপ্নে দেখেছিলেন, দেবী দুর্গা তাঁর মুণ্ড ছেদ করে রক্ত পান করছেন। অন্তিম সময়ে দেবী দুর্গার কাছে মহিষাসুর প্রার্থনা করেছিলেন, দেবী যেন মহিষদেহকে নিজের বাহকরূপে গ্রহণ করেন। দেবী তাতে সম্মতও হয়েছিলেন। উগ্রচণ্ডা, ভদ্রকালী, দুর্গা; তিনবার তিনরূপে দেবী মহিষাসুরের নিধন করেন। মহিষাসুরের প্রার্থনা মেনে তিন রূপেই দেবী মহিষাসুরকে পদতলে ঠাঁই দেন। আজও দুর্গাপ্রতিমায় মহিষের মুণ্ডের উপস্থিতি দেখা যায়। পুজো পান মহিষাসুরও।
প্রথম শতকের যেসব দুর্গা মূর্তি পাওয়া যায়, সেগুলিতে দুর্গা কেবলই অসুরঘাতিনী। কুষাণ যুগের ভাস্কর্যেও পরিবারিক দুর্গার দেখা মেলে না। মার্কেণ্ডয় পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, কালিকা পুরাণেও দেবী এককভাবেই রয়েছেন। নবম থেকে দ্বাশক শতকের মধ্যে তিনি হয়ে উঠলেন পরিবারের কর্ত্রী। বিহার, দিনাজপুর থেকে উদ্ধার হওয়া ভাস্কর্য, ফলকে তিনি মাতৃরূপা, সপরিবারে আবির্ভূতা।
দুর্গার পারিবারিক রূপ বাঙালিয়ানার ফসল। রায়গুণাকর, মুকুন্দ চক্রবর্তীরা সেভাবেই দেবীকে গড়লেন। যুগে যুগে কল্পনার মাধুরী মিশিয়ে মানুষ নিজেই নিজের ঈশ্বরের রূপদান করেছে। দুর্গার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। বাঙালিয়ানা ও বাংলার বৈষ্ণব ধারার অভিঘাতে কোথাও কোথাও দুর্গাপ্রতিমা থেকে মহিষাসুরের অবলুপ্তি ঘটলেও, দেবীর পরিবার সর্বত্র বিরাজমান। জয়া, বিজয়া, পুত্র-কন্যাদের নিয়ে তিনি পূজিতা হন।
‘সপরিবারায়ৈ শ্রী দুর্গায়ৈ বৌষট’- এ মন্ত্র চণ্ডীতে নেই। মাতৃশক্তির আরাধনা করা বাঙালি স্বয়ং এর স্রষ্টা। কারণ, সে গৃহকর্ত্রী দুর্গার পুজো করে। সপরিবারে দুর্গাকে আবাহন করে, নিবেদন করে, আবার বিদায়বেলায় তাম্বুল বরণ করে মিষ্টিমুখ করিয়ে বলে, ‘আবার এসো মা’। মেয়ে বাড়ি এলে পিতৃগৃহে উৎসবের আয়োজন হয়। মেয়ে ফেরার সময় থাকে বিষাদের সুর। তাই তো ছেলেমেয়ে নিয়ে ফি বছর বাপের বাড়ি আসা দেবী একান্নবর্তী পরিবারের প্রতীক হয়ে ওঠেন। হয়ে ওঠেন খাঁটি বাঙালি কন্যে।