বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীর প্রবাদ সত্যি করেছিলেন জোড়াসাঁকো দাঁ বাড়ির শিবকৃষ্ণ দাঁ। একসময় ঠিক করলেন, তাঁর মতো, তাঁর বাড়ির ঠাকুরকেও তিনি গয়না পরাবেন। দুর্গা ও তাঁর চার ছেলেমেয়ের জন্য সোনার গয়নাগাঁটি কত যে গড়ানো হল তার মাপজোক নেই। দাঁ বাড়ির অর্থ ও প্রতিপত্তি এতই ছিল যে শুধু কলকাতার স্বর্ণকারদের থেকেই নয়, প্যারিস জার্মানি থেকে আনানো হত ঠাকুরের সাজ। সেসব বছর বছর প্রতিমার সঙ্গে বিসর্জনও দিয়ে দেওয়া হত তখন। পরের বছর আবার নতুন সাজ।
দেখতে তেমন সুশ্রী ছিলেন না শিবকৃষ্ণ দাঁ। কালো, মোটা, বেঁটেখাটো, অর্থাৎ সৌন্দর্যের চলতি ধারণায় যেমন মানুষকে সুন্দর বলে না। সেই নিয়ে নিজের হীনম্মন্যতা কাটাতেই হয়তো ভরি ভরি সোনার গয়না পরে থাকতেন সারা শরীরে। কতরকমেরই না হার আর বাজুবন্ধ, বালা থাকত তাঁর অঙ্গে সারাক্ষণ। এটা বোধহয় এক ধরনের মানসিক শান্তি দিত তাঁকে। তিনি ভাবতেন, লোকের আমার খুঁতগুলোর ওপর নজর পড়ার আগে, গয়নার ঔজ্জ্বল্যে তাদের চোখই যাবে ধাঁধিয়ে।
সময়টা ১৮৫০-৬০ সাল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তখনও রবি ঠাকুরের জন্ম হয়নি। ঢিল ছোড়া দূরত্বে, দাঁ বাড়ি তখন জমজমাট। রেলের পাত, লোহার কলকবজা ইত্যাদির ব্যবসা চলছে রমরমিয়ে। শিবকৃষ্ণ দাঁ তাঁর বাবা গোকুলচন্দ্র দাঁ-এর ব্যবসার যোগ্য উত্তরসূরি। যদিও তিনি গোকুলচন্দ্র দাঁয়ের নিজের ছেলে নন। বর্ধমান জেলার সাতগাছিয়ার বাসিন্দা গোকুলচন্দ্র দাঁ, ব্যবসা করে প্রচুর সম্পত্তির মালিক হন। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে সেসব সামলাবে কে? তাঁর তো কোনও সন্তানই নেই। স্ত্রীর অনেক কাকুতিমিনতিতে তাই গোকুলচন্দ্র, ভাইয়ের ছেলে শিবকৃষ্ণকে দত্তক নিলেন। তাঁর বয়স তখন মাত্র চার বছর। গোকুলচন্দ্র তাঁকে যেন চোখে হারান। ধীরে ধীরে সে বড় হতে থাকে, আর গোকুলচন্দ্র তাকে একটু একটু করে তাঁর ব্যবসার কাজকর্ম শিখিয়ে বুঝিয়ে দেন। শিবকৃষ্ণ মন দিয়ে সেসব জেনে- বুঝে- শিখে নেন। নিজের কাজে ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ প্রবাদটি সত্যি প্রমাণিত করেছিলেন শিবকৃষ্ণ। সেই সময়ের কলকাতার সেরা ধনবান ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন, জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ। ব্যবসার মুনাফাতেই ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হয়ে চলেছে তাঁর বাড়িতে। ১৮৪০ সাল অর্থাৎ শিবকৃষ্ণকে দত্তক নেওয়ার সময় থেকেই বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন তাঁর পালক বাবা গোকুলচন্দ্র। কিন্তু শিবকৃষ্ণ এমন কিছু করেছিলেন, যার ফলে এ বাড়ির পুজো তারপর থেকে তাঁর নামেই পরিচিত হতে থাকে।
বলাই বাহুল্য, শরীরে এত গয়নার প্রদর্শনী শিবকৃষ্ণকে জনসাধারণের চোখে তো বটেই, ব্যবসায়ী সমাজে এবং তৎকালীন বাবু সমাজেও সম্মান এনে দিয়েছিল। পুজো বা উৎসবের দিনগুলিতে সেসব গয়নার ভার আরও বাড়ত তাঁর শরীরে। সেইরকমই একবার দুর্গাপুজোর আগে শিবকৃষ্ণ ভাবলেন, আমিই যদি এত্ত গয়না পরে সেজে থাকি সারাক্ষণ, মা কেন সাজবেন না? ডাকো স্যাকরাকে। সেই শুরু। শিবকৃষ্ণের তলবে তৎক্ষণাৎ স্যাকরা এসে হাজির বাড়িতে। শিবকৃষ্ণ বললেন, ওহে স্যাকরা, খুব তাড়াতাড়ি তোমায় কিছু গয়না গড়িয়ে দিতে হবে। গয়নার লিস্টি তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে শিবকৃষ্ণ বলেন, পুজো শুরুর আগেই কিন্তু এই সবকটা হাতে চাই আমার। দেখে স্যাকরা বলল, যো হুকুম কত্তা। সব বানিয়ে দেব। কিন্তু গিন্নিমা যদি একটিবার এসে মাপগুলো বলে দিতেন… অট্টহাস্য করে উঠলেন শিবকৃষ্ণ। খানিক পর থেমে বললেন, গিন্নিমায়ের জন্য নয় হে। এ গয়না গড়াচ্ছি, আমার মায়ের জন্য। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল স্যাকরা। এই এত্ত গয়না! শিবকৃষ্ণ নিজের জন্য গয়না বানাতে দেন তাঁর কাছে। ভরি ভরি সোনার গয়নায় নিজের গাত্রশোভা বাড়ান শিবকৃষ্ণ। কিন্তু মাটির প্রতিমার জন্যেও এত্ত সোনার গয়না! মাথার চূড়, নাকের নথ, গলার চন্দ্রহার, হাতের কাঁকন, কানের কুণ্ডল থেকে কোমরের বিছা সঅঅব সোনার! স্যাকরাকে বায়না ধরে দিলেন শিবকৃষ্ণ দেব। সাতদিনের মধ্যেই সব চাই তাঁর। দেরি করা যাবে না। পুজো যে এসে গেল।
সেবার পুজোয়, প্রথমবার সোনার আভরণে সাজলেন শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়ির দুর্গা প্রতিমা। সাল তারিখের সঠিক হিসেব পাওয়া যায় না। তবে সেই শুরু। সীতাহার, চন্দ্রহার, কাঁকন, চূড়, মান্তাসা, কানপাশা, নথ, টায়রা, টিকলি, নূপুর… কী নেই সেই তালিকায়।
মায়ের গায়ের এই বহুমূল্য গয়নার যে আড়ম্বর, তা লোকমুখে কলকাতার অভিজাত বাবু সমাজে ছড়িয়ে পড়ল। আর মানুষের ঢল নামল, জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁর বাড়িতে ঠাকুরের সাজ দেখতে। আর এ বাড়ির পুজোও শিবকৃষ্ণের নামেই পরিচিতি পেতে শুরু করল। সোনা রুপোয় এতরকম সাজ আর এতরকম গয়না দিয়ে সাজানোর সামর্থ্য নাকি আর কোনও বনেদি বাড়ির ছিল না। মুখে মুখে রটে গেল, এ বাড়িতে নাকি মা গয়না পরতে আসেন। দাঁ বাড়ির প্রভাব প্রতিপত্তি এতই ছিল যে শুধু কলকাতার স্বর্ণকারদের থেকেই নয়, প্যারিস জার্মানি থেকে আনানো হত মায়ের সাজ। ব্যবসার প্রয়োজনে যখনই জার্মানি বা ফ্রান্সের সঙ্গে চুক্তি হত, শিবকৃষ্ণ দাঁ সেই সুযোগে মায়ের সাজ আনিয়েছেন সেখান থেকে। দেবী দুর্গার সোনার জরিবোনা শাড়ি, চালচিত্রে ভেলভেটের ওপর সোনার জরির সাজ দিয়ে নজন দেবতার সাজ, আরও কত কী। এখনকার বড় বড় পুজোতেও যেমন দশমীর পুজো শেষ হয়ে গেলে বিসর্জনের আগে মায়ের গায়ের বহুমূল্য গয়না ও সাজ খুলে নেওয়া হয়, এ বাড়িতে কিন্তু সে রীতি ছিল না। অর্থাৎ দেবীপ্রতিমাকে সুসজ্জিত করেই বিসর্জন দেওয়া হত। পরের বছর আবার নতুন সাজ। এ ছাড়া ছিল কলাবউ স্নানের রুপোর কারুকার্য করা বাঁটের ছাতা, যাতে সোনার জরি দিয়ে নকশা করা ছিল। ছাতাটি কিন্তু আজও রয়ে গেছে। আজও এ বাড়ির পুজোয় কলাবউ স্নানে যায় এই ঐতিহ্যমণ্ডিত বহুমূল্য ছাতার ছায়াতেই। শুধু দুর্গা নন, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীর জন্যেও আমদানি করা হয়েছিল সোনার জরি দিয়ে নকশা করা পাড়ের ধুতি, শাড়ি আর গয়না। দেবদেবীদের সোনার জরির কারুকার্য করা সেসব শাড়ি ও পোশাক আজ প্রায় ১৬০-৭০ বছরের পুরোনো, অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। সযত্নে সেগুলি রক্ষিত আছে শিবকৃষ্ণ দাঁ ট্রাস্টের কোশাগারে।
দেবীর সারা অঙ্গে ভরা সোনার গয়নার ঔজ্জ্বল্যে, আর প্রতিমার সাজসজ্জায় সোনা-রুপোর চমক, সাথে ঢাকের বাদ্যি, ধুপের গন্ধ আর পুজোর এলাহি আয়োজনে যে পরিবেশ তৈরি হত, ঈর্ষায় চোখ টেরিয়ে যেত সেকালের তাবড় তাবড় ধনীদেরও। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারও তার মধ্যে অন্যতম। আর সে কথার আঁচ পেয়েই এবাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জনের সময়, বাড়ি থেকে বাঁশের দোলায়, গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যাওয়ার আগে, বাজনদার সমেত ঠাকুরবাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে আনা হত। তারপর ঘাটে জোড়া নৌকা সাজানো হত। সেই জোড়া নৌকায় প্রতিমা মাঝনদীতে নিয়ে গিয়ে, নৌকা দুটি আস্তে আস্তে দুপাশে সরে যেত ও ঠাকুর জলে পড়তেন। এখন সেসব রীতি তুলে দিয়েছেন দাঁ-রা। সম্পত্তি থেকেই এখন যা আয় তা থেকেই চলে পুজোর খরচ। পুজোর জৌলুসও আজ অনেকটাই ম্লান দাঁ বাড়ির পুজোয়, যেখানে এককালে মা নাকি আসতেন গয়না পরতেই।