চেনা বাহনে সফর তো অনেক হল। মর্তে এসে দুর্গাও এবার আম-মানবী। অতএব ভরসা গণপরিবহণেই। আর সেই ভিন-সফরের গল্পই হাজির সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র ‘আঃ! বাহন‘ পর্বে। অফিসক্লান্ত মেয়েদের রোজের বাহন যে মেট্রো, আগমনী দিনে যদি তাতেই শামিল হন দুর্গা? পাতালপুরীতে সে আলোর যাত্রা ছুঁয়ে দেখলেন সরোজ দরবার। অলংকরণে দীপঙ্কর ভৌমিক।
রোদ্দুর এমনই হয়। এই কোথাও নেই। আচমকা চোখ পড়লে খেয়াল পড়ে, সে ঠিক পাশটিতে এসে বসে আছে। আলো করে। শরৎকালের সেই ফুটফুটে লুকোচুরি রোদ্দুরের নাম আগমনী।
কিন্তু পাতালে তো সূর্য ঢোকে না। বন্ধপুরী, অন্ধপুরীতে মেকি আলো। ঠান্ডা শীতল। শাসকের ক্রূর দৃষ্টির মতো। সে পণ্য-আলোয় মানুষ বিপন্ন বোধ করে। উষ্ণতা খোঁজে মানুষ। রোদ্দুরের সঙ্গে তবু মানুষের বড় একটা দেখা হয় না। কতকিছু হারিয়ে গেলে মানুষের মনখারাপ হয়। শুধু এই যে তার হাত গলে পালিয়ে গেছে রোদ্দুর, তার জন্য? মানুষ নিজেকেই আজকাল আর চিনতে পারে না। আর তাই, বরানগরে মেট্রো যখন থমকাল, ফাঁকা সিটে আগমনী রোদ্দুরকে দেখে মানুষ, জনাকয়েক অবাক হল যারপরনাই।
দক্ষিণেশ্বরে কি সে উঠেছিল! নাকি সিট ফাঁকাই! খেয়াল নেই ঠিক। আজকাল মেট্রোয় উঠেই সকলের মোবাইলে মুখ। সিট না পেলে শিট! তবে, রণে-বনে-শয়নে স্বপনে মোবাইল। ওটি হাতে থাকলে আর ওটিটি চালু থাকলে দুনিয়াদারি চুলোয়। এখন রোদ্দুরের দিকে নজর পড়তে থমকে যায় আশ্বিন মাস। দেখে, লেডিস সিট যেন ঠাকুরদালান। মেট্রো আজকাল পাতালছুট। আগমনীর তাই মেট্রো পেতে অসুবিধা নেই।
আগমনী একবার ধর্মতলায় এসে হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকে। লোকে ভাবছিল, সে আসলে কেনাকাটা। একজন বলেছিল, আগমনী আসলে ঢাউস ঢাউস বিজ্ঞাপন। কে যেন শুধু মৃদু স্বরে বলার চেষ্টা করছিল, তা কেন হবে? সে তো একটা গান। গান? শুনে অনেকে মনে করার চেষ্টা করল। কারও স্মরণে নেই। আগমনী নিজেই ভাবছিল, সে তাহলে কে! আলো, গান, শপিং, অর্থনীতি, মহালয়ার রেডিও, নাকি দশ হাতের একটা মেয়ে? দুনিয়া কাঁপানো ঘরের মেয়ে! জানে না ঠিক, নিজের সম্পর্কে অনেক কথাই জানে না আগমনী। কেননা মানুষ তাকে গড়ে নেয় নিজের মনের মতন। গড়ে আবার হারিয়েও ফেলে। হারিয়ে খোঁজে নতুন নতুন রূপে। তবে, সেই দিন থেকে হারিয়ে যাবার ভয় পায় আগমনী নিজেও। ভয় একখানা ন্যাওটা পোষ্য। পায়ে পায়ে ঘোরে। আগমনী তার সঙ্গে একরকম সখ্য পাতিয়ে নিয়েছে আজকাল। আপনাকে এই খোঁজা তো আর ফুরোয় না। তাই প্রতিবার সে নিজেকে নতুন করে পাবে বলে ইচ্ছে করেই নিজেকে হারিয়ে ফেলে। প্রতিবারই একটু ভয় ভয় করে। তবুও এই হারানো খেলা, এই লুকোচুরি পছন্দ তার।
এবার যেমন এই মেট্রোয়। মেট্রোর ভিতর সে হারিয়ে গেল। মেট্রোয় সচরাচর কেউ হারায় না। ট্রেনের মতো মেট্রোর কপালে শরীরে যত্রতত্র নিরুদ্দেশের উদ্দেশে ঘোষণা নেই। তবু, আগমনী যেন লাপাতা লেডিস। যেন পাওয়া আর হারানো কিংবা পেয়ে হারানোর খেলায় মশগুল। সিটদখলের ব্যস্ততায় লোকেরা অবশ্য খেয়ালই করল না যে, কার যেন আসার কথা ছিল মেট্রোয়। মানুষ এত নিজের চারপাশেই ঘুরনচরকি যে কারও আসা-যাওয়ার খবর রাখার সময় নেই। অতএব, বরানগরে এসে সবাই যে তাকে দেখে চমকাবে ভীষণ, সে তো জানা কথাই। কেউ কেউ হয়তো ভাববে, ঐশী ক্ষমতা আছে তার। দৈবী ভেবে কেউ হয়তো আঙুল ঠেকায় কপালে। যেমন, কালীঘাট এলে, বাঙালির একাংশ স্বভাবতই প্রণত।
আসলে বাড়াবাড়ি বাঙালির মুদ্রাদোষ। ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। বাংলার আগমনী রোদ্দুর কি আর সে কথা জানে না! বাঙালি যাকে ভালোবাসে তাকে দেবতা করে। প্রিয় যে আগমনী, তারও তাই দশখানা হাত না হলে তার চলে না। বাঙালির দশে দিক। এদিকে সে দিকভ্রান্ত। দশ টাকার ময়লা নোট পকেটে রাস্তায় বেরিয়ে পয়লা ঝামেলা। তবু, শারদরোদের দশটি হাত তার চাই-ই চাই! দশ হাতের মাহাত্ম্য কি সে হরবখত কীর্তন করে! এদিকে দশ হাতের যে দশ রকম প্রবলেম তা নিয়ে বাঙালির বছর বছর কোনও মাথাব্যথা নেই। যেমন অনেক কিছু নিয়েই থাকে না। নীতি, রাজনীতি, দুর্নীতি। চলছে, চলবে। চলেই যাচ্ছে। গা-সওয়া। বাঙালির মাথা নিয়ে আজকাল যে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন, তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবে, ব্যথা ষোলো আনা সত্যি। সে ব্যথার উপশম যে কীসে, তার ঠিক নেই।
সত্যি বলতে, কত কিছুই যে নেই, বাঙালির তাতে হুঁশও নেই। ট্রাম নেই, বাস নেই, পকেটে রেস্ত নেই, হেস্তনেস্ত নেই অথচ কুছ পরোয়া নেই। এ পৃথিবীতে যা ঘটে তাতে রোদ্দুরের হাত আছে বটে। কিন্তু রোদ্দুরের দশ হাত নেই। অথচ বাঙালির আবদার। সে একমুঠো শারদীয় রোদকে মনের মতো করে সাজিয়ে নেয়। তারপর বলে, মাতৃরূপেণ, কন্যারূপেণ সংস্থিতা। অগত্যা, আগমনী দশ হাতেই মেট্রোয় ঢুকতে যায় আর গোঁত্তা খায় জোরে। দেখে, পার্ক স্ট্রিটে তারই মতো একজন কেউ আছে বটে, তবে বাইরে, আলাদা ঘেরাটোপে। তবু সে হাল ছাড়ে না। আগমনী রোদ আজ মেট্রোর্মা অমৃতংগময়ঃ।
উঠেই দেখে গেটের পাশে দুজন গ্যাঁট। স্বর্গে যেন দ্বাররক্ষী। ফলে রাস্তা হল সরু, গেট কেটে অর্ধেক। আর কাপল হলে তো কথাই নেই। কোথাও তো লেখা নেই যে, চলন্ত মেট্রোয় প্রেমে পড়া বারণ! তা প্রেম করে করুক। প্রেমে মানুষ নরম হয়। সহমর্মী হয়। সেই একবার প্রেম নিয়ে কোন এক মেট্রোদাদু ক্যাচাল বাধিয়েছিলেন। কলকাতা কেঁপে গিয়েছিল। প্রোগ্রেসিভ নাগরিক চালচিত্তিরের ভিতরই তো প্যাট্রিয়ার্কির দাদাশ্বশুর। অতএব, সেসব ঝাড় সমেত উপড়ে ফেলাই ভালো। তবে, সে বহু মনীষার কাজ। তাই প্রেম করলে আগমনীর আপত্তি নেই। শুধু গেটের দুপাশে ঠেসে দাঁড়ালে ঢোকার জো থাকে না! তার উপর আবার দশ হাত! আগমনী তার বাকি সব কল্পিত হাত উড়িয়ে দেয় তিলোত্তমার বুকে। সেই সব হাত-ই তখন শহরের শক্তিপীঠ। কেউ কেউ জানে সে-কথা। অনেকেই জানে না।
তা ছাড়া দশ হাত যে থাকতেই হবে এ আবার কী গা-জোয়ারি! দেবীত্বের জোরাজুরি। আগমনী তো দেবী হতে চায়নি। এ-কথা সত্যি যে, মানুষ তার হাতের গুণেই মানুষ। দুটো হাতেই তার জগৎ উদ্ধার। দশ হাতের কল্পনায় সম্ভ্রম নাহয় স্পষ্ট। তাই বলে লতা মঙ্গেশকর কি সুনীতা উইলিয়ামসের তো দশ হাত লাগে না। সিনেপাড়ার মঞ্জু মাই একেই বলে, ‘ফিরড’ চলছে। আগমনীও জনে জনে গিয়ে কানে কানে বলে আসে, যে মেয়ে ধান কাটে, লোকের বাড়ি বাসন মাজে, অফিসে কি-বোর্ড পেশে, সে-মেয়ে দু’হাতেই দশের সমান। দশে দিকভ্রান্ত হওয়ার অতএব কোনও মানে নেই। মেট্রোয় অবশ্য মন না দিলেই দিকভ্রান্ত। গেট খোলে মেপে মেপে বাঁদিকে আর ডানদিকে। এদিক ওদিক হওয়ার উপায় নেই। যারা রোজ যায়, তাদেরই মুখস্থ। আগমনী খেয়াল করে, মানুষ কেমন যে-কোনও বাঁধা সিস্টেমে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
আগমনীর সঙ্গেই এখন অফিসক্লান্ত মেয়েরা ফিরছে বাড়িতে। ওদের মেট্রোতেই যাতায়াত। অথচ পাঁজিটা কেমন উল্লুক দেখো! মেয়ের কীসে আগমন? না, সেই গজ, অশ্ব, নৌকা, দোলায়। ফল, সেই ছত্রভঙ্গ, মড়ক, শস্যপূর্ণ বসুন্ধরা অমুক তমুক। বাঙালির নববর্ষে পাঁজি আর শীতে বোরোলীন। এক ঢোল, এক কাঁসি। বদলায় আর না। যে মেয়ে খেটে ফিরছে, তার মেট্রোই বাহন। ফল কী? সংসারে সুখ! আরে ছো! সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, এ-ও তামাদি কথাবার্তা। মেয়ের মেট্রোয় আগমন এবং গমন। ফল, সমাজের অগ্রগতি।
দেখতে দেখতে শহুরে পাতালগাড়ি এসে পৌঁছল ধর্মতলা। কদিন আগে এখানেই রাত দখল করে নিয়েছিল উজ্জ্বল একঝাঁক রোদ্দুর। গোটা মহানগরেই। এক টুকরো রোদ্দুর কে যেন চুরি করে নিয়ে গিয়ে খুন করে গুম করতে চেয়েছিল। জানত না, রোদ্দুর থেকে রোদ্দুর নিলে রোদ্দুরই পড়ে থাকে। শহরের রাত ভেসে গেল তাই সেই খর রোদে। জাগরণে আগমনী। ঘুম যেন ভাঙল বাঙালির। প্রত্যেকের দু’হাতেই নতুন স্বপ্নের দায়িত্ব। সমবেত চালচিত্রে যারা দাঁড়াল তারা দশভুজাই বটে। দেবী নয়। মানবী। সমষ্টির হাত দশ কেন, সহস্র হতে পারে। ব্যক্তির বিসর্জনে তার বোধন।
লোক থিকথিক মেট্রো অবশ্য এখন আর রোদ্দুরের দেখা পাচ্ছে না। ঘোষণা হচ্ছে, অন্তিম স্টেশনে খালি করে দিতে হবে কামরা। যে যার কুটিরে ফেরা এবার। আগমনী রোদ্দুর যাবে পুজোবাড়ি, বারোয়ারি মণ্ডপে। বেরোনোর সময় টোকেন ফেলতে গিয়ে দেখল, এই যা! খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। কার্ড ছিল, তাও রয়ে গেছে কৈলাসে! থাকুক গে! এখন মনে পড়ে, সে এসেছিল শূন্য হাতেই। শূন্যের ঘর ভেঙে গেলে মহাশূন্য। আগমনী জানে, তাকে যেতে হবে বহুদূর।
মেট্রো আবার ছুটবে উলটোদিকে। কলকাতার তলা দিয়ে। গঙ্গার তলা দিয়েও ছুটছে মেট্রো। সেই নিয়ে থিম। কলকাতার ভিতর আর-এক কলকাতা। যা রোজের অভ্যেস, তাকেই হঠাৎ নতুন করে পাব বলে মেতে উঠবে মানুষ।
আর আগমনী রোদ্দুর?
সে আর-একটা নতুন মেট্রোসফরের অপেক্ষা করে। প্রতিবার মেট্রো এসে দাঁড়ালে যে মেয়েটা পড়িমরি ছোটে, আর ঠিক মুখের উপর এসে বন্ধ হয়ে দরজা, আগমনী গিয়ে হাত রাখে তার কাঁধে। তারপর দুজন হাত ধরাধরি করে ওঠে পরের মেট্রোয়। মুখচেনা আরও তিনজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। হাতে হাত রাখা থাকে ওদের। ওরা সহযাত্রী। আত্মীয়। ওরা সকলেই তখন রোদ্দুর, আগমনী।
মেট্রো এগিয়ে যায়। সেই এগোনোর নাম উৎসব। কালীঘাট, যতীন দাস পার্ক, এলগিন…। এক-একটা স্টেশন। এক-একটা গাঁট। আগমনী রোদ্দুর আর তার সহচরীদের আলোয় তখন ভেসে যায় পাতালপুরী। তারপর সেই আলোর কুচি টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে তিলোত্তমায়। কলকাতা আবার কল্লোলিনী হবে। আর সেই কল্লোলের মুখে আরশিনগর হয়ে জেগে থাকে এক-এক কুচি রোদ্দুর। মানুষ তার ক্লেদ-ক্লিন্নতা সমেত দেখতে পায় নিজেকে, তখনই জেগে ওঠে।
আজও কেউ কেউ উজ্জ্বল সেই রোদ্দুরকে ত্রিনয়ন নামে চেনে। ত্রিনয়ন, সেই ত্রিনয়ন, একফোঁটা যে জিরোয় না।
আরও পড়ুন: