চেনা বাহনে সফর তো অনেক হল। মর্তে এসে দুর্গাও এবার আম-মানবী। অতএব ভরসা গণপরিবহণেই। আর সেই ভিন-সফরের গল্পই হাজির সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র ‘আঃ! বাহন‘ পর্বে। খুচরো আর প্যাসেঞ্জার নিয়ে যে অটোচালকের নিত্য নিমপাতা-খাওয়া মুখ, সেই অটো-বাহনেই যদি এবার চড়ে বসেন মা দুগ্গা? কেমন হবে সে যাত্রা, ঘুরে দেখলেন সম্বিত বসু। অলংকরণে দীপঙ্কর ভৌমিক।
দুর্গা ল্যান্ড করেই বুঝলেন, ‘শক্তি’র সঙ্গে কানেকশন লস্ট! শক্তি– কৈলাসের ওয়াইফাই, তা যতক্ষণ আছে, দুগ্গাকে দেখে কে! পাসওয়ার্ড ছিল ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র’, কিন্তু তা এখানে আর কী কম্মে লাগবে! ম্যাদামারা সমতলে নেমে এই এক বিপত্তি! ফলে এখন একেবারে আমমানবী। শুধু চাইলে মাঝে মাঝে ত্রিনয়ন বড় বড় করে আর হাত দশখানা বের করে ভড়কে দিতে পারেন। এ ছাড়াও দেবী মনে মনে কী একটা সুপারপাওয়ার নিয়ে যেন ঘুরছেন। মর্তে এসে তিনি প্রমাণ করেই ছাড়বেন, আমমানুষের থেকে তাঁর দেমাক ঢের বেশি!
কলকাতায় পেট কালচারের রবরবা থাকলেও, সঙ্গের সিংহটি নিয়ে আসতে এইবারে মনের জোর পাননি একেবারেই। মানুষজনের কী মতলব কে জানে, বেমক্কা বর্শা ছুড়ে মেরে-টেরে দেবে! তা ছাড়া পেট-ল্যাগ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে! পথেই কোন এক ডাকাবুকো ক্রেশে, মর্তে বলে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ’, সেখানেই টুক করে ড্রপ করে দিয়েছেন, ফেরার পথে আবার তুলে নেবেন। যতই দেবী-টেবী করে সাজানো হোক, এই সময় ওইরকম প্যান্ডেলে বিপুলাকায় শো-পিস হয়ে থাকতে এক্কেরে চান না তিনি। তা ছাড়া অত গঙ্গাজলের ছিটেয় গতবার ঠান্ডা লেগে গিয়েছিল। কী হাঁচি! ভাগ্যিস প্যারাসিটামল আর বোরোলীন প্রতিবার যাওয়ার সময় থরে থরে নিয়ে যান কৈলাসের বাড়িতে।
সে যাগ্গে, বাপের বাড়িতে বাকিদের সান্টিং করে কলকাতার কী হাল দেখতে বেরিয়ে পড়েছেন তিনি। গত কয়েক বছর হল, কলকাতায় অটো নিয়ে নাকি জনগণ খুব জেরবার! নানা সময়, দুগ্গার কাছে নোটিফিকেশন যায়, নানা সংবাদমাধ্যম থেকে: অটোওয়ালার সঙ্গে যাত্রীর বচসা কিংবা খুচরো সমস্যা কিংবা যেতে না-চাওয়া! এতকাল তো বাহনের পিঠে চেপেই সাঁইসাঁই করে হাওড়া ব্রিজ, মিনার্ভা থিয়েটার, আহিরীটোলা, কাশীপুর বা সাউথ সিটির ছাদ– দুগ্গা দিব্যি অবতীর্ণ হয়েছেন। অটোতে চেপে হাজরা পেরোচ্ছেন যখন, মনে হচ্ছিল স্যাট করে নেমে ম্যাডক্সটা ঘুরে আসি। কিন্তু কী আর করবেন, ম্যাডক্স এখন জলছপছপে। পুজোর সময় যে লোকে-লোকারণ্য হয়ে বসে আড্ডা মারে, কতবার ভেবেছেন, ‘ধুর নিকুচি’ বলে মঞ্চ থেকে নেমে একটু কোল্ড ড্রিংকে গলা ভিজিয়ে আসবেন। কুইজে পার্টিসিপেট করবেন। বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটাবেন। প্যাটিস কামড়ে জিভে গরম লাগলে হু-হা করবেন! কিন্তু চাইলেই কি সব করা যায়! সব কিছুর তো একটি নীতি-ফীতি আছে। তা ছাড়া অমনটা করলে লোকে ভিরমি খেয়ে মরবে। কেউ ভাববে ইউটিউব চ্যানেলের জন্য করা প্র্যাংক। কেউ ভাববে উত্তর-আধুনিক পরিকল্পনার ঠাকুর– এই ভেবে শিল্পীকে একগোছা পুরস্কার দেবে! মাঝখান থেকে এত বাইট এত বাইট দিতে হবে নানা মিডিয়া মহলে, তাও আপাদমস্তক মানুষ সেজে– সে ভারি ঝক্কির ব্যাপার! কেউ যদি আধার কার্ড চেয়ে বসে! কাগজ দেখাতে বলে! – এসব তাও ভালো। কিন্তু যদি বলে ‘ধুর এসব মিথ্যে, পুরোটাই এআই!’ আর যাই হোক, দৈবশক্তির এমন অবমাননা দুগ্গা করতে চাননি!
কালীঘাট-গড়িয়াহাটের অটোতে যাওয়ার পথে পড়ল মিছিল। স্বাস্থ্যবান অটোওয়ালা এই মিছিল-জ্যামে পড়ে বিন্দুমাত্র খিটখিটেমি দেখাননি দেখে খানিক বিস্মিতই হলেন দেবী। এমনকি, এ-ওস্তাদ যেতে যেতে ডাইনে-বাঁয়ে পান-গুটকার পিকটিও ফেলে না!
কলকাতা কি বদলে গেল নাকি! লোকে লোকারণ্য এবার তবে আমি আসছি বলে নয়, তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে! দেবী ভাবলেন, তাও ভালো, প্রতিবার মা… মাগো… বলে এটা চাই আর সেটা চাই– এত চাওয়া নিয়ে যাই কোথায়! এখন এক দফা, এক দাবি। এরকম তো আমার কাছেও করতে পারে। সকলের নানা দাবির ফাইল পড়ে পড়ে চোখের পাওয়ার বেড়ে গেছে। মর্তে যদিও লেন্স পরেন। তা ছাড়া কোভিডের পর অ্যালঝাইমার্স হওয়ার প্রবণতাও নাকি মানুষের বেড়েছে। মানুষের বেড়েছে মানে, দেবদেবীদেরও বাড়বে। ফলে সকলের সব দাবি আপাদমস্তক মনে রাখা সম্ভব না। কিন্তু এ জিনিস বলবেন কাকে, কে-ই বা পৌঁছে দেবে আমআদমির কানে!
অটোয় যদিও এখনও সেই রেডিও। কোথায় আর বাংলা গান! হিন্দি ঝিনচ্যাক শুনতে ইচ্ছে করে না। লক্ষ্মী শোনে বটে। বলে, হিন্দিতে টাকা ভালো, বাংলায় অর্থকড়ি কম। এই গানবাজনার জেরে বাপের বাড়ির মোবাইল ফোনখানা বের করলেন দুগ্গা। ‘নারদ’ কোম্পানির সিম– শুধুমাত্র অসীমের লোকজনদের জন্য। ইয়ারফোন বের করে শুনতে থাকলেন ‘সংবাদ প্রতিদিন শোনো’। মর্তে ল্যান্ড করে বাবার কাছ থেকে শুনেছেন এখন বাজারে ‘পডকাস্ট’ ব্যাপারটা দারুণ জমেছে! আর শোনো-তে নাকি রোজই নানা লেখা-বলার ছর্রা। শুধুমাত্র কান খোলা রেখে দশহাতে কাজকম্ম চালিয়ে যাওয়া এক্কেবারে সম্ভব! ফলে দেবী তাই শুরু করলেন। অটো অবশ্য একটু তড়িৎ গতিতে চলছিল, পাশের বাইক থেকে কে একটা মুখখারাপও করল র্যাশ ড্রাইভিংয়ের জন্য, কিন্তু কুছ পরোয়া নেই– দু-কানে ‘শোনো’, বাজে জিনিস শুনো না! তা ছাড়া কলকাতায় হাঁটলে-চললে এমন দু-দশখানা গাল-ভরা কথা তো শোনাই যায়। জীবন থাকলে, বিরক্তিও থাকবে, মুখখারাপও থাকবে।
গড়িয়াহাটে নামার সময়, টের পাওয়া গেল, অটো পুরনো একটি গুণ অন্তত বজায় রেখেছে। বাসন্তী দেবী কলেজের গায়ে দেবী নামতে না নামতেই একটা ১০০ টাকার নোট ধরিয়ে দিলেন অটোচালকের হাতে। শোলের যেমন ‘কিতনে আদমি থে?’, বসের যেমন ‘কাজটা হল?’, অটোয় তেমন ‘খুচরো দিন’– এই ডায়লগ চিরকালীন। দুর্গা প্রস্তুতই ছিলেন। এইবার তিনি দশহাত দেখালেন। ত্রিনয়নও বড় বড় করলেন। দশহাতের প্রতি তালুতে দেখালেন ১২ টাকার খুচরো। কিন্তু বেচারা সেই অটো বিনা খুচরোয় সিগনাল ভেঙে সাঁ করে মুহূর্তে উধাও!
এ তেমন বড় কথা নয়! বড় কথা হল, এত খুচরো দেবী পেলেন কোথায়? কৈলাসে ফেরার সময়, সেই যে গঙ্গায় ডুব দিয়েছিলেন গতবার, তখনই জলের তলা থেকে খুচরোগুলো তুলে রেখে দিয়েছিলেন। পণ করেছিলেন, অটোওয়ালাকে খুচরো দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে, মানুষ পারে না তো কী, দেবদেবীরা সব পারে! সে যতই মর্তে এসে শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হোক! পকেটে খুচরো রাখা আসলে সুপারপাওয়ারের মধ্যেই পড়ে! দৈবজীবনে কত অগা-বগাকেই তো ভড়কে দিয়েছেন, কিন্তু দশতালুতে খুচরো না দেখিয়ে মাইরি, আপনিই বলুন, অটোওয়ালাদের অন্য কী উপায়েই বা রগড়ে দেওয়া যেত?
আরও পড়ুন: