ঘোর অনাচারে সমাজ যখন বিপন্ন, তখনই আবির্ভাব দুর্গার। বিপন্নদের ক্রোধ থেকেই উদ্ভূত হচ্ছেন তিনি, যিনি বিপন্নদের ত্রাতা হয়ে উঠবেন। দুর্গার আবির্ভাবের পুরাণকাহিনিতেই রয়েছে এই বিপন্নতা ও প্রতিরোধের আখ্যান।
এক অস্থির সময়ের মধ্যে ঘনিয়ে এসেছে দেবীর বোধনের ক্ষণ। নারী নির্যাতনের একটি তাৎক্ষণিক ঘটনা সমস্ত নারীর বিপন্নতার শিকড়ে টান দিয়েছে। সেই নির্যাতনের প্রতিবাদ যখন নারীদের যৌথ দ্রোহে জেগে উঠছে, সেই প্রতিবাদের আবহে মিলেমিশে যাচ্ছে দুর্গার ধারণা। মহিষাসুরমর্দিনী দেবীর সংহারের রূপটি। অন্যায়ের প্রতিবাদে এক নারীর রুদ্ররূপ যেন বাস্তবের নারীদের প্রতিবাদে প্রতিমা পাচ্ছে। এই মিলে যাওয়ার সূত্রটি আদতে রয়ে গিয়েছে দেবী দুর্গার আবির্ভাবের পুরাণকাহিনিতেই।
আরও শুনুন:
শুধু কৌরবদের হাতে নয়, স্বামী পঞ্চপাণ্ডবের হাতেও লাঞ্ছিতা হয়েছিলেন দ্রৌপদী
মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবী-মাহাত্ম্য তথা শ্রীশ্রী চণ্ডী বলে, অসুরদের অত্যাচারে দেবকুল যখন বিপর্যস্ত, সেই বিপন্নতার আবহেই পরিত্রাণের জন্য তাঁরা দেবীর শরণ নিয়েছিলেন। সেসময় ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে সমগ্র স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল অধিকার করেছে মহিষাসুর। তার অত্যাচারে দেবদেবীরা ত্রস্ত, মুনিঋষি-মানুষেরা নির্যাতনের ভয়ে আতঙ্কিত। কিন্তু ব্রহ্মার বর অনুযায়ী ত্রিলোকের কোনও পুরুষই পরাস্ত করতে পারবে না মহিষাসুরকে। ক্ষমতার দম্ভে নারীকে প্রতিপক্ষের মর্যাদা দেয়নি মহিষাসুর, তাই ব্রহ্মার কাছে বর চাওয়ার সময়েও সে নারীর উল্লেখ করেনি। তাই নারীর হাতেই তার নিধন হবে, এই লক্ষ্যে এক হলেন দেবতারা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের ক্রোধাগ্নি এবং অন্য দেবতাদের তেজ সম্মিলিত হয়ে আবির্ভাব হল দুর্গার। যিনি দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।
যে রূপে দেবী মহিষাসুরকে হত্যা করেছিলেন, তাঁর সেই রূপের নাম মহামায়া অথবা চণ্ডী। অসুরকে হত্যার সময় রোষপরায়ণা ছিলেন বলেই দেবীর নাম হয়ে যায় চণ্ডী। ‘শ্রীশ্রী চণ্ডী’তে মধু-কৈটভ, মহিষাসুর, চণ্ড-মুণ্ড আর রক্তবীজের সঙ্গে শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধের বর্ণনা পাওয়া যায়। এখানেই দেবীকে বন্দনা করে বলা হচ্ছে,
ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ । ৭৫
ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা ।।
অর্থাৎ, হে দেবী, আপনিই এই জগৎ ধারণ করে আছেন। আপনি এই জগৎ সৃষ্টি করেন, আপনিই তা পালন করেন এবং সর্বদা প্রলয়কালে আপনিই তা সংহার করেন।
আরও শুনুন:
বস্ত্রহরণ শুধু নয়, মনে রাখা জরুরি দ্রৌপদীর ন্যায়বিচারের আরজিও, ভোলেননি কৃষ্ণ
পরের শ্লোকেও বলা হচ্ছে,
বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে । ৭৬
তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতোঽস্য জগন্ময়ে ।।
অর্থাৎ, হে জগৎস্বরূপা, আপনি এই জগতের সৃষ্টিকালে সৃষ্টিশক্তিস্বরূপা, পালনকালে স্থিতিশক্তিস্বরূপা এবং প্রলয়কালে সংহারশক্তিস্বরূপা।
ভয়ঙ্কর যুদ্ধের শেষে মাতৃরূপী শক্তির হাতে ধরাশায়ী স্বর্গের ত্রাস দুর্দান্ত অসুর। মহিষের ভেক ধরা এই অসুর আসলে দুর্গতি আর অন্ধকার ডেকে আনা অশুভ শক্তি। তার বুকে বিঁধে আছে ত্রিনয়নী এক দশভুজার ত্রিশূল। তাঁর প্রবল পরাক্রম, অবিচল প্রত্যয় আর কঠিন দৃষ্টি যেন ভস্ম করে দিচ্ছে অসুরের তেজ, আর এ পৃথিবীর যাবতীয় পাপ! সমাজে ঘোর অনাচার থেকে জমে ওঠা ক্রোধের নাম হয়ে উঠছে দুর্গা।