মামাবাড়িকে দেখিয়ে দেবেন বলেই বাপের বাড়িতে দুর্গাপুজো করার জেদ ধরলেন, বেহালার জগৎরাম মুখার্জীর বড় মেয়ে জগত্তারিণী। কিন্তু সে তো পুজোর অষ্টমীর দিন। পুজো হবে কীভাবে? একরাতের মধ্যেই করতে হল সব জোগাড়। পরদিনই ঘট আর পট এনে হল একদিনের দেবীপুজো। ভাঁড়ারের কলাইয়ের ডাল দিয়েই হল ভোগ রান্না। বর্তমানে সেই বাড়ির ঠাকুরদালানে সোনার দুর্গা প্রতিষ্ঠিত। আজ ২৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, বেহালার সোনার দুর্গা বাড়িতে হয়ে চলেছে দুর্গাপূজা।
বেহালার জগৎরাম মুখার্জীর পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড় জগত্তারিণী। বড় আদরের। বড় দিদিকে চার ভাইও মাথায় করে রাখেন। জগৎরামের দুই ছেলের বিয়ে হয়েছে সবে। সেবার অষ্টমীতে দুই ভাজকে নিয়ে, জগত্তারিণী গিয়েছেন ঠাকুর দেখতে, তাঁদের মামাবাড়ি বেহালার বর্ধিষ্ণু হালদারবাড়িতে। প্রথমবার ভাজদের নিয়ে এসেছেন পুজোগন্ডার দিনে। ভেবেছিলেন অনেক আদর-আপ্যায়ন, খাতির-যত্ন হবে। কিন্তু গিয়ে দেখলেন কোথায় কী! তাঁদের বাড়ির লোকের আওতায় ফেলে অন্য লোকেদের আতিথেয়তাতেই ব্যস্ত সকলে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মনোক্ষুণ্ণ জগত্তারিণী, ভাজদের নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। এসেই বাবার কাছে আবদার জোড়েন, বাড়িতে দুর্গাপুজো করতে হবে বলে। অপমানের শোধ তাঁর চাই-ই। জগৎরাম আর কী করেন! মেয়ের কথা যদি মেনেও নেন, তবু দেবীপক্ষের অষ্টমী পর্যন্ত শেষ। পুজো হবে কীভাবে? পুজো হল পরদিন। ঘট আর পট এনে নবমীতেই পুজো শুরু হল মায়ের। আর ভোগেরও তো আয়োজন করতে হবে! জগৎরাম মুখার্জীর ভাঁড়ারে যে কলাইয়ের ডাল পড়ে ছিল, তাই দিয়েই হল ভোগ রান্না। এভাবেই একদিনের পুজো হল জগৎরামের বাড়িতে।
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: মা গয়না পরতেন যে বাড়িতে, বিলেত থেকে দুর্গার সাজ আনাতেন শিবকৃষ্ণ দাঁ
দশমীতে সেই ঘটের বিসর্জনের পর জগৎরাম যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলেন। আর যাই হোক, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে রেষারেষিতে যাওয়ার ইচ্ছে তাঁর ছিল না। আসলে কৃতজ্ঞতা কি অত সহজে ভোলা যায়! জগৎরামের আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের যশোরে। সেখান থেকে এসে মুখোপাধ্যায় পরিবার ব্যারাকপুরের কাছে থাকতে শুরু করে। সেখানে বিয়ে থা করে দিব্যি সংসারও করছিলেন জগৎরাম। কিন্তু তাঁর বয়স যখন বছর তিরিশ, গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এমনই অবস্থা যে তাঁকে মৃত মনে করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। শোনা যায়, ভাসতে ভাসতে তিনি আদি গঙ্গার তীরে একটি জায়গায় পৌঁছন। সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু প্রাণে বাঁচলেও, নিজের বাড়িতে আর ফেরা হল না জগৎরামের। সেকালের নিয়ম ছিল, অন্তর্জলির জন্য একবার যাকে ঘর থেকে বের করা হয়েছে, কখনও কোনও কারণেই আর ঘরে ফেরানো যাবে না তাকে। অতএব, ওই অঞ্চলেই ডেরা বাঁধলেন জগৎরাম। তখন বেহালার এই হালদার পরিবারই কুলীন ব্রাহ্মণ জগৎরামের সঙ্গে তাঁদের মেয়ের বিয়ে দিয়ে তাঁকে জাতে তোলে। বেহালায় আবার সংসার শুরু করেন জগৎরাম। জগত্তারিণী তাঁর সেই দ্বিতীয় পক্ষেরই মেয়ে।
সেই অষ্টমীর রাতের আবদারকে ছেলেমানুষি জেদ ভেবে, জগৎরাম প্রথমে পাত্তা দেননি। কিন্তু তলে তলে জগত্তারিণী যে সারা বছর ধরে, দুনিয়া সংসারের ফেলে দেওয়ার জিনিস বেচে বেচে, পুজোর জন্য ৫টা গোটা টাকা জোগাড় করে ফেলেছেন, সে খবর তাঁর কাছে ছিল না। জগৎরামের ছেলেরাও তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকুরে। সবাই মিলে আবদার জুড়ল, এবার তাহলে পুজোটা ভালোভাবেই হোক বাড়িতে। সেটা ১৭৭০ সাল। জগৎরাম মুখার্জীর বাড়িতে প্রথমবার মাটির প্রতিমা এল। চণ্ডীপাঠ থেকে বিসর্জন, সবটাই হল বিধি অনুসারে। আর সেই থেকেই শুরু হল সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে, বাড়িতে সমস্ত অতিথি আমন্ত্রিত থেকে রবাহুত পথচারী সকলকে ভোগ খাওয়ানো। এই দিক থেকে অন্তত সত্যিই টেক্কা দিতে পেরেছিলেন জগত্তারিণী তাঁর মামাবাড়িকে।
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: কুণ্ডুবাড়ির ঠাকুরদালানে কড়ায় বাঁধা থাকেন দেবী দুর্গা
তবে বর্তমানে সে বাড়ি সোনার দুর্গা বাড়ি নামে পরিচিত। এই সোনার প্রতিমার সঙ্গে কোনও ঐতিহাসিক যোগ নেই যদিও। এ বাড়িতে পুজো হয় তান্ত্রিক মতে। অর্থাৎ বলিদান হয়। এ বাড়ির পুজোয় সন্ধিপুজো হয় না। একসময় হত। সন্ধিপুজো বন্ধ হওয়ার এক গল্প বলে থাকেন এবাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা। ঘটনাটা ঘটে ১৮৯০ সাল নাগাদ। সন্ধিপুজোর সব জোগাড় করা হয়েছে। কুমারীকেও সাজানো হচ্ছে। কিন্তু পুজোয় বসার সময় হঠাৎ দেখা গেল কুমারীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই তো এখানে ছিল, কোথায় গেল? আশপাশের সব জায়গা, পুকুরঘাট, জঙ্গল সবই দেখা হল কিন্তু কোত্থাওই আর পাওয়া গেল না তাকে। শোনা যায়, উপস্থিত কেউ কেউ নাকি দেবীপ্রতিমার হাতের মুঠোয় লাল চেলির আভা অদৃশ্য হতে দেখেছিলেন বলে দাবি করেন। এরপর সেবার আর কুমারী পুজো করা সম্ভব হয়নি। পরে পরিবারের গুরুদেবের বিধান অনুযায়ী তাঁরা নবমীতে কুমারীপুজো করলেও সেবারই শেষ সন্ধিপুজো হয়েছিল জগৎরামের বাড়িতে।