কানে কানে কে যেন বলে গেল, ‘ওই জেলের ঘরে, ১৪ হাত মাটি খুঁড়লেই আমায় পাবি’। স্বপ্নে যেমন বলা ছিল, মাটির নীচ থেকে হুবহু সেই মূর্তিই পাওয়া গেল। বিধর্মীদের হাত থেকে, দেবীমূর্তিকে রক্ষা করার তাগিদেই হয়ত কেউ মাটির নিচে সেটি লুকিয়ে দিয়ে থাকবেন। প্রায় সাড়ে চারশো বছর ধরে বাগবাজারের হালদারবাড়িতে পূজিতা হয়ে আসছেন, স্বপ্নাদেশে পাওয়া এই কষ্টিপাথরের মহিষমর্দিনী।
জমিদারির দক্ষিণ দিক বরাবর, তিনি হাঁটছেন তো হাঁটছেন। অনেকটা সময় পেরিয়েছে। ক্লান্ত অবসন্ন, একা জমিদারবাবু। কেউ কোত্থাও নেই। তেষ্টায় বুক গলা শুকিয়ে কাঠ। আবার গনগনে রোদের তাপে চাঁদি ফেটে যাওয়ার জোগাড়। কিছু দূরে একটা ছাউনি দেখা যাচ্ছে। সেখানেই শেষ হচ্ছে তাঁর জমিদারির সীমানা। কে থাকে এই খড়ের ছাউনিতে? তার কাছেই কি পাওয়া যাবে, জমিদারবাবু যা খুঁজছেন? কিন্তু কী খুঁজতে এসেছেন তিনি? হন্যে হয়ে হেঁটে এসেছেন যে এতদূর! এমন সময়, কে যেন তাঁর কানে কানে বলে গেল, ‘ওই জেলের ঘরে, ১৪ হাত মাটি খুঁড়লেই আমায় পাবি’। ঘুরে দেখতে গেলেন জমিদারবাবু, কে? কে বলল কথাটা? আর ঘোর কেটে গেল।
আরও শুনুন: নামে সিংহবাহিনী, অথচ বাহন ঘোড়া! দেবী দুর্গার এই বাহনের কী বিশেষত্ব জানেন?
দেখলেন তিনি নিজের বিছানায় শুয়ে আছেন। রোজকার মতো। উঠে, খানিক দোলাচলেই বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর জমিদারির দক্ষিণ সীমানার শেষ প্রজা, সেই জেলের ঘরের উদ্দেশে। অমোঘ কিছু একটার খোঁজে চলছেন যেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছে যেতে হবে। দেখতে পেলেন সেই একান্তে পড়ে থাকা একটি ঘর। গরিব প্রজার সম্মতিতেই খোঁড়া হল তার ঘরের মাটি। ঠিক কতটা সময় ধরে, আর কত হাত মাটি, তা গোনার মতো অবস্থা ছিল না তখন। তবে স্বপ্নে বলা ছিল – ‘১৪ হাত মাটি খুঁড়লেই আমায় পাবি।’ কথাটার যেন অনুরণন হচ্ছিল জমিদারের মন-মস্তিষ্কে। অবশেষে, মাটির নিচ থেকে হুবহু স্বপ্নে বর্ণিত কষ্টিপাথরের মূর্তি তুলে আনা হল। কষ্টিপাথরের দেবীমূর্তির অঙ্গের কালোয়, আলো হয়ে ফুটে থাকা চোখের সাদা মণিজোড়া। সম্পূর্ণ অক্ষত। মূর্তির আঙুলের আংটির সূক্ষ্ম কারুকার্জও স্পষ্ট। দশ হাতে দশ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহিষাসুর বধ করছেন দেবী। তাঁর বাহন বাঘ। সঙ্গে আছেন জয়া, বিজয়া। আর মাথার ওপর মহাকাল। এই গোটা মূর্তিটিই রয়েছে পদ্মের ওপর।
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: শুধু সিংহ নয়, দেবী চিত্তেশ্বরী দুর্গার পায়ের নীচে কেন বাঘ থাকে জানেন?
‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’। বাগবাজার হালদারদের কষ্টিপাথরের মহিষমর্দিনী লাভের গল্প যেন এই প্রবাদবাক্যকেই সত্যি করে। মহা আনন্দে সেই মহিষমর্দিনীর মূর্তি বাড়িতে এনে নিত্যপূজা শুরু করে দেন হালদার জমিদার। সে আজ থেকে প্রায় চার, সাড়ে চারশো বছর আগেকার কথা। মনে করা হয়, জায়গাটা বর্তমানের ওড়িশা রাজ্যের বালেশ্বর জেলার সাহেবপুর এলাকা। মূর্তির গড়ন ও গায়ের কারুকার্জ দেখে মনে করা হয় এটি পাল রাজাদের আমলে তৈরি। সেই হিসেবে, আজ থেকে প্রায় হাজারখানেক বছর আগে তৈরি হয়েছে কষ্টিপাথরের এই দেবীমূর্তিটি। বিধর্মী আক্রমণ থেকে বাঁচাতে, দেবীমূর্তিকে রক্ষা করার তাগিদেই হয়তো কেউ মাটির নিচে সেটি লুকিয়ে দিয়ে থাকবেন। সেই তথ্য পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালে, বাইরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর দেবী নিজেই পুজোর ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। শহর কলকাতার যে কটি পরিবারে প্রাচীনতম দূর্গামূর্তি সংরক্ষিত রয়েছেন বা পূজিতা হয়ে আসছেন সেগুলির মধ্যে বাগবাজারের হালদার বাড়ি অন্যতম।
হালদারদের আসল পদবি গাঙ্গুলী। তারা ব্রাহ্মণ। হালদার তাদের পাওয়া উপাধি। কলকাতায় চলে আসার আগে, হুগলির চুঁচুড়ায় যখন তাদের জমিদারি ছিল, এটা সেই সময়ের গল্প। এ বাড়ির পুজোর সঙ্গেও রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের যোগ। এ বাড়ির রাখালদাস হালদার মহাশয়, শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী ভক্তদের একজন ছিলেন। এই বংশের অনেকের নামই কলকাতার ইতিহাসে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। যেমন, বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদার। তাঁর সময় হালদার বাড়ির দুর্গাপুজো খুবই প্রসিদ্ধি লাভ করে। বিখ্যাত ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকার, ১৮০৭ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রাণকৃষ্ণ হালদারকে, চুঁচুড়ার খ্যাতনামা জমিদার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। ওই পত্রিকাতেই, প্রাণকৃষ্ণ হালদারের বাড়ির দুর্গাপুজো উপলক্ষে নাচের আসরের আমন্ত্রণপত্রটিও, ছাপা হয়েছিল। তিনি চুঁচুড়ার প্রাসাদোপম বাড়ি বেচে কলকাতার বাগবাজারে এসে বাড়ি তৈরি করেন। এ বাড়ির ধর্মদাস হালদারের সাথে ইংরেজদের খুব সখ্য ছিল। তাঁর সময়ে ইংরেজরা হালদার বাড়ির পুজোতে নিমন্ত্রিত থাকত। কষ্টিপাথরের ছোট মূর্তিতে দেবীমাহাত্ম্য, বিদেশিদের কাছে ঠিকভাবে প্রকাশ পাবে না ভেবে, সে সময় তিনি বাড়িতে বড় মৃন্ময়ী মূর্তি আনার চল শুরু করেন। পুজো কিন্তু হত সেই আসল কষ্টিপাথরের দেবীমূর্তিতেই। পরে অবশ্য একসময় মৃন্ময়ী মূর্তি আনা বন্ধ হয়ে যায়। তবে হালদারদের মূল বাড়িতে কষ্টিপাথরের মহিষমর্দিনী আজও নিত্যপূজিতা।
একসময় কষ্টিপাথরের কালো মূর্তি রাঙিয়ে তোলা হয়। প্রতিবছর দূর্গাপুজোর আগে, দেবীমূর্তিতে রং দেওয়ার এই বিশেষ রীতি ‘অঙ্গরাগ’ অনুষ্ঠান নামে প্রচলিত। গঙ্গাজলে স্নান, পুরনো রঙের আস্তরণ খসিয়ে – ক্ষার, পটাশে গাত্র মার্জনা করে আখের রসে ডোবানো হয়। তারপর দেবীপ্রতিমায় নতুন রং করা হয়।
এ বাড়ির পুজোর রীতি অনুযায়ী, ষষ্ঠীতে বাড়ির মেয়ে-বৌরা মাছ খেয়ে, পান মুখে দিয়ে মা-কে বরণ করতে যান। তারপর মাটির মালসায় বাটাচিনি আর লেবুর শরবত দেওয়া হয় মা-কে। এছাড়া এ বাড়ির পুজোর বিশেষত্ব হল ভোগের আয়োজনে চাল, ডাল, দুধ সবেরই ওজন থাকে ৫ পো করে। বোধনের দিন থেকে গোটা পুজোর সময় রেডির তেলের অনির্বাণ ‘জাগ-প্রদীপ’ জ্জ্বালানো থাকে। তাঁদের বিশ্বাস অনুযায়ী মা দক্ষিণ দিকে মুখ করে মর্তে আসেন। তাই বোধনের পর থেকে, পুজোর কটা দিন দেবীমূর্তিকে দক্ষিণমুখী করে রাখা হয়। সারাবছর তিনি পূর্বদিকে মুখ করে থাকেন। পুজোশেষে শুধু, ঘট বিসর্জন হয়।