এ বাড়ির ঠাকুরদালানের পেছনের দিকের দেওয়ালে রয়েছে একটি বড় লোহার কড়া। ষষ্ঠীর দিন দেবীপ্রতিমা ঠাকুরদালানে চৌকিতে বসানোর সময়, প্রতিমার কাঠামো, হলুদ রঙে ছোপানো পাটের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় সেই কড়াতে। কুণ্ডুবাড়ির বিশ্বাস, এভাবেই রজমণি দাসী তাঁর বাড়ির ঠাকুরদালানে বেঁধে রেখে গিয়েছিলেন মা-কে। যাতে তিনি তাঁর সন্তানদের সংসারে অচলা হয়ে থাকেন। প্রায় ১৫০ বছর ধরে, ৬ নম্বর প্যারীমোহন পাল লেনের, তিন খিলানের ঠাকুরদালানে পূজিতা হয়ে আসছেন দেবী দূর্গা, যার সূচনা করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র কুণ্ডু ও তাঁর স্ত্রী রজমণি দাসী।
এবার দুর্গাপুজোয় বাপের বাড়ি থেকে ফিরে আসা ইস্তক স্বামীর কাছে জেদ ধরে বসেছেন রজমণি দেবী। আবদারটা তাঁর অনেক দিনের। নানা বাহানা করে বুঝিয়েসুঝিয়ে স্ত্রীকে এতদিন সামলেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র কুণ্ডু। কিন্তু এবার আর কোনও বাধা-বারণই শোনবার মতো অবস্থাতে নেই রজমণি দেবী। এবার আর না করতে পারবেন না স্বামী। একটা সমাধান নিয়েই ফিরেছেন তিনি বাপের বাড়ি থেকে। রজমণির বাপের বাড়িতে প্রতি বছর ঘটা করে দুর্গাপুজো হয়। তাঁর বাপের বাড়ির অবস্থা বেশ সচ্ছল। দাদারা সবাই মিলে সেখানে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন বেশ জাঁকজমক করেই। রজমণি দাসীর খুব ইচ্ছা তাঁর বাপের বাড়ির মতো শ্বশুরবাড়িতেও দুর্গাপুজো হোক। তিনি নিজে নতুন কাপড়ে, ঠাকুরদালানে বরণ করে তুলবেন দেবী দুর্গাকে। কিন্তু তাঁর স্বামী কৃষ্ণচন্দ্র কুণ্ডুর আর্থিক অবস্থা তেমন নয় যে, বছর বছর দুর্গাপুজোর মতো একটা আড়ম্বর করার দায়িত্ব কাঁধে নিতে পারেন। রজমণির বড় মনখারাপ তাই। বিয়ের পরও পুজোর চারদিন তাই তিনি বাপের বাড়িতেই থাকেন। আর পুজোর সময় মা-কে মন দিয়ে ডাকেন, ‘মা, মা গো, আমার বড় ইচ্ছা আমার বাড়িতেও তোমার পুজোর আয়োজন করি। তুমি একবার মুখ তুলে চাও মা।’
সেই যে মুশকিল আসানের কথা হচ্ছিল! এবার সেটাতে আসি। এবার পুজোতে বাপের বাড়ি গিয়ে দাদাদের মধ্যে, তাঁদের নতুন ব্যবসা নিয়ে কথা বলতে শোনেন রজমণি। দাদারা বলছিলেন এবার নাকি নতুন ব্যবসায় ভালো মুনাফা হয়েছে তাঁদের। আর তাই দিয়েই এবার পুজোয় মায়ের জন্য অতিরিক্ত শাড়িও বরাদ্দ হয়েছে পুজোতে। রজমণি কান পাতলেন শোনার জন্য। কীসের ব্যবসার কথা বলছে দাদারা? এমনিতে ব্যবসাপাতিতে তাঁর তেমন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু, দাদারা যখন মুনাফা আর মায়ের জন্য প্রণামী শাড়ির কথা বলল, তখন রজমণির মনে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। শুনতে পেলেন দাদারা কেরোসিনের ব্যবসা করছেন। আর তাতেই নাকি অনেক মুনাফা হয়েছে তাঁদের। রজমণির শুকনো মুখ আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হতে লাগল। তাঁর সামনে যেন কোনও একটা রাস্তা খুলে গেছে। স্বামীর কাছে গিয়ে কথাটা না বলা অবধি যেন তাঁর তর সইছে না।
বাপের বাড়ি থেকে ফিরেই, স্বামীর কাছে পাড়লেন কথাটা। বললেন, তুমি তো জানোই, আমার অনেকদিনের ইচ্ছা বাড়িতে দুর্গাপুজোর আয়োজন করি। তুমি আর অমত কোরো না। কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, দেখো রজো, স্ত্রীর শখ আবদার মেটানো সব স্বামীরই কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কিন্তু তোমার এই আবদার মেটাব আমার সেই সামর্থ্য কই! রজমণি বললেন, তুমি কেরোসিনের ব্যবসা করো না গো। ওতে অনেক মুনাফা। দাদারাও ওই ব্যবসাই করছে। আমি নিজের কানে শুনে এসেছি।’ শহরে অনেকেই তখন এই নতুন ব্যবসায় টাকা লাগিয়ে মুনাফা করছেন। রজমণি দাসী অন্দরমহলের মানুষ। ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে তাঁর তেমন জ্ঞান না থাক, কৃষ্ণচন্দ্র কুণ্ডু যে এসব নিয়ে খোঁজ রাখেন না তা তো নয়। কেরোসিনের ব্যবসায় দেশীয় ব্যবসায়ীরা সব লাভবান হচ্ছেন, ঠিক কথাই। তিনি স্ত্রীকে বললেন, – ‘রজো, আমার অবস্থা তো সবই তুমি জানো। ব্যবসা যে শুরু করব তার জন্য তো মূলধন চাই, সে জোগাড় হবে কোত্থেকে!’ রজমণি বললেন, ‘সে সব আমি জানি না বাপু। তোমাকে এবার একটা ব্যবস্থা করতেই হবে, ব্যাস।’ যেন তিনি পণ করে এসেছেন এবার। সুতরাং, ব্যবস্থা একটা করতেই হল। যেটুকু যা জোগাড় করতে পারলেন তাই দিয়ে কেরোসিনের ব্যবসা শুরু করলেন কৃষ্ণচন্দ্র কুণ্ডু।
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: গয়না পরেই ভাসান দেবীর, দুর্গাপুজো হত জোড়াসাঁকোর ব্রাহ্ম ঠাকুরবাড়িতেও
আর এদিকে পুজোর জোগাড় শুরু হল। তখন ১২৭৬ বঙ্গাব্দ। কলকাতার, ৬ নম্বর প্যারীমোহন পাল লেনের বাড়িতে, তিন খিলানের ঠাকুরদালান তৈরি করালেন কৃষ্ণচন্দ্র কুণ্ডু। নতুন শাড়িতে মা-কে বরণ করে ঠাকুরদালানে তুললেন রজমণি দাসী। তবু আশা-নিরাশার দোলাচল লেগেই ছিল তাঁর মনে। প্রথমবার এমন বড় একটা আয়োজন করছেন। অর্থের সংকুলান কৃষ্ণচন্দ্রের ভাঁড়ারে তখনও খুব একটা বেশি নেই। অনেক ঝক্কি পুইয়ে শুরুটা তো হয়ে গেল, কিন্তু মায়ের পুজোর সবটা ঠিকঠাক সামলাতে পারবেন তো? দিনরাত সেই চিন্তা রজমণি দাসীর। পুজোর একদিন, দুদিন কেটে গেল এভাবে। তৃতীয় দিন রাতে রজমণি দেবী একটি স্বপ্ন দেখলেন। এ কী, এ যে হুবহু এ বাড়ির দুর্গাপ্রতিমা! কিন্তু উনি কি কিছু বলছেন? কী বলছেন? কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন রজমণি। দেবী বলছেন, চিন্তা করিস না। সব ঠিক হবে। রজমণি যেন অস্ফুটে বললেন, পুজো যদি শেষ করতে না পারি মা? তার উত্তরেই যেন দেবী বললেন, – ‘নবমীতে থোড়ের নৈবেদ্য দিয়ে পুজো করিস আমায়। অর্থাভাবে কখনও যেন আমার পুজো বন্ধ করিস না।’ ঘুম ভেঙে যায় রজমণির। দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করেন দেবীর উদ্দেশে। আর সেই দিন থেকেই নবমীতে দেবীর নৈবেদ্যর জন্য, থোড় কুচি করে তাতে মধু মিশিয়ে দেওয়া, হয়ে ওঠে এবাড়ির পুজোর এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এরপর ব্যবসায় লাভ হতে থাকলে, থোড়ের নৈবেদ্যর পাশাপাশি চন্দন ক্ষীরও পরিবেশন করা হতে থাকে দেবীর উদ্দেশে।
এ বাড়ির ঠাকুরের বিশেষত্ব হল, একচালা ঠাকুরের সঙ্গে লক্ষ্মী গণেশ কার্তিক সরস্বতী তো আছেনই, রয়েছেন জয়া বিজয়াও। প্রতিপদ থেকে, বৃহৎনান্দিকেশর মতে পুজো শুরু হয় এ বাড়িতে। নবম্যাদিকল্পের পুজো। বাড়িতে কোনও আমিষ রান্না হয় না পুজোর এই কয়দিন। নেই অন্ন ভোগের রীতিও। দশমীতে কনকাঞ্জলির পর, দধিকর্মা করে বাড়ির মেয়ে উমা-কে বিদায় জানান সকলে। সন্ধিপুজোতে, ৪০ কেজির নৈবেদ্য ও তার ওপর, দেড় কিলো নাড়ুর একটি মুণ্ডি দেওয়া হয়।
রজমণি দাসী ছোটবেলা থেকেই ছিলেন খুবই ভক্তিমতী। তাই তাঁর অবর্তমানেও যাতে দেবী এ বাড়িতে অচলা হয়ে থাকেন, করে গিয়েছিলেন সেই বন্দোবস্তও। কীরকম? এ বাড়ির ঠাকুরদালানের পেছনের দিকের দেওয়ালে রয়েছে বড় একটি লোহার কড়া। ষষ্ঠীর দিন অধিবাসের পর দেবীপ্রতিমাকে ঠাকুরদালানে চৌকিতে বসানোর সময়, হলুদ রঙে ছোপানো পাটের দড়ি দিয়ে প্রতিমার কাঠামোকে বেঁধে রাখা হয় সেই কড়ার সঙ্গে। এভাবেই রজমণি দাসী, তাঁর ঠাকুরদালানে বেঁধে রেখে গিয়েছিলেন মা-কে। মা আমি তোমাকে এখানে বেঁধে গেলাম – আমার ঘরে অচলা হয়ে থেকো, এমনটাই বুঝি সেদিন বলে গিয়েছিলেন এই ভক্তিমতী নারী।