সময় সময় আলোর সাজ বদলে যায়। অর্থও। যে-আলো অনেক মানুষকে এক করে তুলতে পারে, সেই আলোকে আমরা প্রণাম করি। যে-আলো দিশাহীন বিভ্রান্তির ভিতর পথ বাতলে দিতে পারে, সেই আলোর সামনেই আমরা নিবেদন করি আমাদের অঞ্জলি। বানিয়ে তোলা আলোর রোশনাই একদিন তো ফুরোবেই। কিন্তু অন্তরের জাগপ্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার পালা তো ফুরোনোর নয়। সেই জাগরণের কথা শোনালেন সরোজ দরবার।
আলোর অপেরা ফুরিয়ে এল। আনন্দের পসরা খালি করে কে যেন ফিরে গেছে আজ। যে এসেছিল বলে ঝলমলে মানুষের মুখ। অন্তত কয়েক ঘণ্টা বা মুহূর্তের জন্য। তবে ততটাও কি ঝলমলে, অন্তত এবার! হয়তো হয়েছিল, কিংবা নয়। তবে, এ-কথা সত্যি এই আসা-যাওয়ার গল্পের ভিতর খানিক জাদু আছে। ইন্দ্রজাল। মায়াকাঠি ছুঁয়ে কে যেন প্রতিবার আমাদের ক্লিন্ন জীবনকে বদলে দেয় লহমায়। কে বদলায়? উত্তর অনেকরকম হতে পারে। আমরা তার ডাকনাম দিয়ে থাকি- উৎসব।
সেই উৎসব এবার যেন খানিক অন্য অর্থ পেয়ে গেল। এই কষ্টের পৃথিবীতে একমুঠো আনন্দের জোনাকি ক্রমাগত আমাদের আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যায়। ক্ষুধা আর ক্ষোভ, আমাদের দৈন্য আর অসুখের গল্পগুলো তো সহজে বদলায় না। বদলাতে দেওয়া হয়ও না। সময়ের অভিঘাতে কখনও তা স্পষ্ট। এতটাই প্রকট যে চোখে যেন কাঁকর পড়ে। কখনও আবার সেসব চোখের সামনে থেকেও যেন নেই। তবু বিপর্যস্ত শহরে নেমে আসা বৃষ্টির মতোই প্রতিবার উৎসব আসে। যখন মানুষ নিজেই যেন খানিক বদলে যায়। তার ভিতরে জ্বলে উঠে নরম সহমর্মী আলো। সেই আলোয় পাশের মানুষটিকে ঠিক আর ততখানি অসহ বলে মনে হয় না। শ্রান্ত জীবনকে ততখানি বিরক্তিকর বোধ হয় না। বরং সাধ্যমতো খড়কুটো জোগাড় করে মানুষ আগুন জ্বালে। ভাবে নিজেকে অগ্নিশুদ্ধ করে নেওয়ার কথা। ভাবে তো! কতটাই বা আর তা সম্ভব হয়ে ওঠে! তবু এই ভাবনাটুকু ফেলে দেওয়ার নয়।
সময়ের সাপ ইতিহাসের গলি বেয়ে এঁকেবেঁকে চলে যায়। যে-সময় দু’মুখো সাপের মতো নিজেই নিজেকে খেতে শুরু করে, সেখানে এসে এই উৎসবও অন্য অর্থ পেয়ে যায়। মনে হয়, তা যেন জোর করে গায়ে চাপিয়ে দেওয়া একখানা সুদৃশ্য উত্তরীয়। তাকে পরতে গেলে বাধে, খুলতে গেলে লাজে। উৎসব তো শুধু এক অর্থে প্রতিভাত হয়নি কখনোই। নীতি, অর্থনীতি, উদ্যোগ, আয়োজন, সফলতা, বিফলতার হাজারও অনুষঙ্গ হু-হু করে ধেয়ে আসে উৎসবের সঙ্গে। যেন একদল খেলুড়ে ছেলেপিলে তাদের সর্দারকে সামনে রেখে দৌড়চ্ছে। এই জড়িয়ে যাওয়া অর্থের জাল থেকে একা একা উৎসবের সঙ্গে দেখা হওয়াই মুশকিল। বরং এক-এক সময় মনে হয়, সে যেন মস্ত এক প্রমোদ তরণীর সওদাগর। তবু উৎসব থাকে। যেখানে আলো জ্বলার কথা নয়, সেখানে জ্বলে ওঠা আলোর মালার পাশেই নিশ্চুপ এসে দাঁড়ায় উৎসব। যে সখ্য কল্পনার অতীত, আচমকা হাতে হাত রাখা সেই সখ্যের গায়ে লেগে থাকে এক পরত উৎসব। অকীর্তিত যে মানুষ জীবনের মার খেতে খেতে মুখ থুবড়ে পড়ে, সেই মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর আকুতির ভিতর এসে বসে উৎসব। তার সাধ-আহ্লাদে নিজেকে সাজিয়ে তোলার পাশে শরতের শিউলির মতো জেগে থাকে উৎসব। উৎসব তবে কে? আমাদের দৈনন্দিন এই ক্ষয়ে যাওয়া জীবনের বিরুদ্ধে সে যেন মূর্তিমান প্রতিবাদ। শোক, অসুখ, ক্ষুধা, ক্লান্তির উলটো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা সে এক বিশুপাগল। যার দিকে তাকালে বন্ধ গড়ের ভিতর এখনও খানিক আলো দেখা যায়। উৎসব তাই আলোর হরকরা।
এই আলো অবশ্য মোটেও একরকম নয়। সময় সময় আলোর সাজ বদলে যায়। অর্থও। যে-আলো অনেক মানুষকে এক করে তুলতে পারে, সেই আলোকে আমরা প্রণাম করি। যে-আলো দিশাহীন বিভ্রান্তির ভিতর পথ বাতলে দিতে পারে, সেই আলোর সামনেই আমরা নিবেদন করি আমাদের অঞ্জলি। যে-আলো আমাদের ভিতরমহলে অন্ধকারের টুঁটি জাপটে ধরে বিদেয় করে, সেই আলোকেই আমরা পুজো করি। বানিয়ে তোলা আলোর রোশনাই একদিন তো ফুরোবেই। নিয়ম তেমনই। যেন গল্প কিংবা সিনেমার বাস্তবতা। তা যতই আবিষ্ট করে রাখুক না কেন, সময়ের সীমাবদ্ধতা তার থাকেই। অতএব আলোর সাজানো মিছিল ফুরিয়ে আসে। আনন্দের বাদ্যি কমে যায়। ফিরে আসার পর এবার ফিরে যাওয়ার গল্পের দিকে এগিয়ে যেতে হয় সকলকেই।
তবু গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যায় না। ফিরে যাওয়ার গল্পের গায়ে গায়ে থেকে যায় ফিরে আসার গল্পটাও। সব আলো নিবে গেলে তাই প্রদীপের হয় আয়োজন। ফাঁকা বেদির উপর তার একা জেগে থাকা। উৎসব আসে, চলেও যায়। শুধু বেঁচে থাকে এই জেগে থাকার কাহিনিটুকু। বাস্তবতার যে অপর পারে ক’টা মুহূর্তের জন্যও পৌঁছনো গিয়েছিল, মানুষে মানুষে বেঁধে বেঁধে থাকার যে অনুভবের শরিক হওয়া গিয়েছিল, তা কি এবার হাতছাড়া হবে? হতে পারে, যদি আমরা নিজেদের ভুলে যাই। আর উৎসবকে আমরা বেঁধে রাখতে পারি, যদি আমরা জেগে থাকি। সব রোশনাই ফুরনোর পর ওই নিঃসঙ্গ প্রদীপের মতোই। এই জেগে থাকাটুকুই কোজাগরী। মানুষের বেঁচে থাকার অস্ত্র। তাই বুঝি বিজয়ার আর-এক অর্থ অস্ত্রও বটে!
তাই শুধু যাওয়া-আসা নয়, কেবলই স্রোতে ভাসা নয়। উৎসব আসলে জাগরণের একখানা ছোটগল্প। ফুরিয়েও যা ফুরোয় না।