তিথির নাম ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। তবু কারও কারও ফোঁটা হয় প্রতিপদে। তবে নিয়ম তো কেবল নিয়ম নয়, তার নেপথ্যেও থাকে জল হাওয়া। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সেই জলহাওয়ার গল্পই।
লৌকিক গল্প বলে, যমী বা যমুনার তপস্যার জোরে মৃত্যুর পরেও ফের বোনকে দেখা দিতে ফিরে এসেছিলেন যম। আর ভাইকে রক্ষা করার জন্য যমুনার সেই তাগিদকে ছুঁয়েই ভাইয়ের দীর্ঘ আয়ুটুকু চেয়ে নেন আপামর বাংলার মেয়েরা। ভাইয়ের কপালে দই চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে প্রার্থনা করেন- “যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা/ আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা/ আজ হতে ভাইয়ের আমার যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা।” বাংলা পঞ্জিকা মতে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, আর সেই ভ্রাতৃদ্বিতীয়া তিথিকে উপলক্ষ করে এইভাবেই বাংলার ঘরে ঘরে ভাইকে আগলে রাখার মন্ত্র পড়েন মেয়েরা। কিন্তু যে তিথির নামেই দ্বিতীয়ার যোগ, সেই ফোঁটা কেউ কেউ প্রতিপদে দেন কেন? অনেকের মুখেই শোনা যায়, দ্বিতীয়াতে নয়, প্রতিপদে ফোঁটা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে তাঁদের পরিবারে। দেখা যায়, এই আলাদা নিয়মের শরিক যাঁরা, সকলেরই শিকড় পূর্ববঙ্গে। উপলক্ষ এক, তবে উদযাপনে খানিক গরমিল। শুধু ফোঁটা দেওয়ার দিন ক্ষণ তিথি আলাদা নয়, ফোঁটা দেওয়ার সময়ে বলা ছড়া, ফোঁটার উপকরণ ইত্যাদির মধ্যে সেই ফারাক চেনা যায়। ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা’-র বহুশ্রুত ছড়া বদলে গিয়ে বলা হয়, ‘প্রতিপদে দিয়ে ফোঁটা দ্বিতীয়াতে দিয়ে নিতা, আজ হতে আমার ভাই যম দুয়ারে তিতা।’ কেউ বলেন ‘দ্বিতীয়াতে নিতা’, কেউ আবার বলেন ‘দ্বিতীয়াতে খাইয়ো নিতা’।
আসলে এই ছড়ার মধ্যে থেকেই চিনে নেওয়া যায় প্রতিপদে ফোঁটা হওয়ার আড়ালে থাকা কারণটিকে। সত্যি বলতে, নিয়ম তো কেবল নিয়ম নয়। তার নেপথ্যে থাকে জল হাওয়াদের গল্প। কোনও না কোনও কারণে রীতি তৈরি হয়, রীতি বদলে যায়। অনেক পরের দিনে সেইসব জলহাওয়া যখন আর আমাদের গায়ে লেগে নেই, তখন কেবল রীতিটুকুই পড়ে থাকে, গল্পেরা হারিয়ে যায়। যেমন হারিয়ে গিয়েছে প্রতিপদের ফোঁটার নেপথ্যে থাকা নদীমাতৃক বাংলাদেশের গল্প।
আসলে, যে পূর্ববঙ্গে ভাইফোঁটা প্রতিপদে দেওয়া হয়, তা নদীমাতৃক। যাতায়াতের ভরসা নৌকা। ভাইফোঁটা যে সময়ে হয়, তখনও সদ্য শেষ হওয়া বর্ষার নদী ফুলেফেঁপে একাকার। ভাই দ্বিতীয়াতেই ফোঁটা নিতে আসবেন, আবার সেদিনই অনুষ্ঠান সেরে ফিরে যাবেন, এমনটা নাই হতে পারে। তা ছাড়া নদী উজিয়ে এসে ঘন ঘন দেখাসাক্ষাৎও তো হয় না বিবাহিত বোনের সঙ্গে ভাইয়ের। তাই একদিনে ফোঁটা, আরেক দিনে ‘নিতা’ অর্থাৎ ‘নেওতা’ বা নিমন্ত্রণ। ভাইকে আরও একটা দিন কাছে পাওয়া, তাকে কাছে বসে খাওয়ানো- বাড়ি ছেড়ে দূরে চলে আসা বোনের সাধ এইটুকুই।
এখনকার দিনে ভাইবোনেরা অবশ্য আরও আরও দূরে চলে গিয়েছেন। সাত সাগর আর তেরো নদীর কোনও কোনোটা এসে জুড়ে বসেছে তাঁদের মাঝে। রেল-বিমানের যুগে নৌকা বাওয়ার সেদিন ফুরিয়েছে হয়তো। তবে সেই পুরনো দিনের গন্ধ মেখেই রয়ে গিয়েছে পুরনো প্রথা।
[ছবি: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়]