নিত্যদিনের না-পাওয়ার জীবনে বাঙালি অনেক কিছুই ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে গিয়েছে, তবে পুজোর ছুটিতে হাত পড়লে সে কিন্তু ছেড়ে কথা বলে না। তারই প্রমাণ পেয়েছিল উনিশ শতকের বাংলা। খোদ পার্বতীপুত্র গণেশের কাছেই ছুটির দরখাস্ত পাঠিয়েছিল সেকালের বাঙালি। ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন? আসুন, শুনেই নেওয়া যাক।
‘কাছে এল পূজার ছুটি/ রোদ্দুরে লেগেছে চাঁপাফুলের রঙ।’
আর সেই ‘ছুটির আয়োজন’ হবে কেমনতর, তারই বর্ণনা দিয়ে গিয়েছেন রবি ঠাকুর। যেখানে শহরের কলেজে পড়তে আসা ছাত্র খাতায় ফর্দ টুকে নিচ্ছে, সদ্যপ্রকাশিত উপন্যাস থেকে ‘মনে-রেখো’ পাড়ের শাড়ির। দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরে যে প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হবে, তার জন্যে শহর থেকে তো উপহার নিয়ে যেতেই হবে! আবার কোনও বাড়িতে আলাপ চলছে সরু মোটা গলায়, এবার আবুপাহাড় না মাদুরা, নাকি ডালহৌসি কিংবা পুরী- কোথায় বেড়াতে যাওয়া হবে পুজোর ছুটিতে। একে উৎসবের আনন্দ, তায় ছুটি- দুয়ে মিলে এই সময় বাঙালি সপ্তম স্বর্গের দেখা পায়। ফলে এই সময়কার ছুটিটাকে টেনেটুনে বাড়িয়ে নেওয়ার দিকে তার মন পড়ে থাকে। আর বাঙালির সেই পুজোর ছুটিতেই নাকি হাত দেবে সরকার! তেমনটাই ঘটেছিল সেকালে। বাঙালিও ছেড়ে কথা বলেনি। রাগে ক্ষোভে সরাসরি পার্বতীপুত্র গণেশের কাছেই দরবার করেছিল সেকালের বাঙালি।
সময়টা উনিশ শতক। দিনকাল তখনও আরেকটু ঢিমেতালে চলে। পুজোয় অধিকাংশ অফিসকাছারিতেই লম্বা ছুটি বরাদ্দ। বাঙালি কেরানি বাবুদের একটা বড় অংশের বাড়ি তখনও গ্রামেই, চাকরি করতে শহরে এসেছেন। কর্মস্থলে বাসা ভাড়া করে থাকেন আর ছুটিতে বাড়ি যান। বড় ছুটি পেলে তাঁদের টানা কয়েকদিন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোরও সুযোগ মেলে। এহেন পরিস্থিতিতে আচমকা শোনা গেল, সেই ছুটিতেই নজর পড়েছে ইংরেজ সরকারের। ফল, লম্বা ছুটি বাতিল। দুর্গাপূজার ছুটি কমানোর জন্য সরকার যে কমিটি তৈরি করেছিল, সেই কমিটিই ঘোষণা করে, পুজো উপলক্ষে সরকারি অফিস মাত্র চারদিন ছুটি থাকবে। আর সেই ঘোষণার পরেই, ১৮৭৯ সালের ১৪ অক্টোবর গণেশের উদ্দেশে একটি চিঠি প্রকাশিত হয়, ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকার পাতায়। তার শিরোনামে লেখা ‘ছুটির দরখাস্ত’। আর চিঠির সম্বোধন, অনারেবল লম্বোদর রায় বাহাদুর সি, এস, আই বরাবরেষু।
কী লেখা ছিল সেই চিঠিতে?
চিঠিতে বলা হয়:
“হুজুর মায়ের সাথে বছর বছর এসে থাকেন, সুতরাং আমাদের বিষয় আপনি ভাল ওয়াকিবহাল আছেন। আমরা আপনাদের শুভাগমন উপলক্ষে ফি বছর বার দিন করিয়া ছুটি পাইয়া আসিতেছি। এবার ত কোনরূপ কেঁদে ককিয়ে সেই ছুটি মঞ্জুর রহিল, কিন্তু আস্ছে বছর থেকে আর তাহা পাওয়া যাইবে না। বড় লাট সাহেব হুকুম দিয়াছেন যে আগামী বছর থেকে চার দিনের অধিক আর কেহ ছুটি পাইবে না। আমারা ছাপোষা লোক, কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে ঘর করি, ভূতের মত খেটে বৎসরান্তে স্ত্রী পুত্র পরিবারের মুখ দেখিতে কি সাধ যায় না? সমবৎসর পরিশ্রম করিয়া হাড় মাটি করি খেটে খেটে প্রাণ বেরিয়ে যায়, তার উপর আবার উপরি পাওনাও বিলক্ষণ আছে, মধ্যে মধ্যে লাথি ঝাঁটাও খেতে হয়, কত রকম মন যুগিয়ে কাজ করি। ইহাতেও গরিবদের উপর এত লাঞ্ছনা?”
লাটসাহেব গণেশের অন্তরঙ্গ, সেই কারণেই তাঁকে এ চিঠি লিখছেন, জানাচ্ছেন পত্রলেখকেরা। চিঠির শেষে আবেদন রয়েছে, মা দুর্গার কাছে এই দরখাস্ত পেশ করারও।
বলা বাহুল্য, রসিকতার ছলেই এ চিঠি লেখা। ছুটি পাওয়ার তাগিদ সেকালের বাঙালিরও ছিল, তবে অনেক না-পাওয়ার মাঝেও নিজের রসবোধটিকে যে সে সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছিল, এ চিঠি সে কথাই বলে।