দুর্গার উপাসনা করতেন এক সাহেব! তাও প্রত্যেক বছর! ভক্তিভরে উপোস করে অঞ্জলি দিতেন তিনি। হ্যাঁ, এমন ঘটনার সাক্ষী আমাদের এই বাংলা।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এক পর্তুগিজ খ্রিস্টান সাহেব গান বেঁধেছিলেন, “জয় যোগেন্দ্র-জায়া মহামায়া, মহিমা অপার তোমার”। দেবী দুর্গার স্তব করেছিলেন কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি। যিনি বিভিন্ন গানে বারবার বলতে চেয়েছিলেন, আসলে ঈশ্বরের কোনও ভেদ হয় না। ভেদ হয় না ভক্তেরও। যে কোনও ধর্মের, যে কোনও জাতের, যে কোনও শ্রেণির মানুষেরই অধিকার রয়েছে ঈশ্বরের যে কোনও রূপের উপাসনা করার। আর ঠিক সেই কাজই করেছিলেন বীরভূম নিবাসী এক সাহেব। স্বয়ং দেবী দুর্গার আরাধনা করতেন তিনি। প্রত্যেক বছর।
আজ যে শান্তিনিকেতন বাঙালির কাছে অতি চেনা একটি নাম, তার কাছাকাছিই রয়েছে সুরুল গ্রাম। আঠেরো শতকের শেষদিকে সেই গ্রামেই থাকতেন সাহেব জন চিপস। অবশ্য লোকের মুখে মুখে তাঁর নাম হয়ে গেছিল চিকবাহাদুর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন যখন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ষোল। এ দেশে এসে কিন্তু হিল্লে হয়েই গেল। কোম্পানিতে রাইটার, অর্থাৎ কনিষ্ঠ কেরানির কাজ জুটে গেল একটা। তারপর ভাগ্যদেবীর কৃপা বর্ষিত হল তাঁর উপর। এজেন্ট হয়ে উঠলেন জন চিপস। ফেঁদে বসলেন তুলা, রেশম, লাক্ষার কারবার। বীরভূমে পাকাপাকি ঘাঁটি গাড়লেন সাহেব। গড়ে উঠল তাঁর কুঠি।
আরও শুনুন: প্রথম বাঙালি লাখপতির বাড়ির পুজো কেমন ছিল জানেন?
কিন্তু একটা সময় ব্যবসায় মন্দা এল। কিছুতেই অবস্থা বদলায় না। কুঠিতে লোক লশকরের কমতি ছিল না। তাদেরই একজন, দেওয়ান শ্যামকিশোর সিংহ একটা বুদ্ধি বাতলালেন শেষমেশ। কী বুদ্ধি? না, দুর্গতিনাশিনী দুর্গার পুজো করা যাক। মায়ের কৃপায় যদি কপাল ফেরে। তা ডুবতে থাকা মানুষ তো খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে। সাহেবের তখন সেইরকমই দশা। সুতরাং তিনি অমত করলেন না। এমনকি নিজে উপোস করে অঞ্জলি অব্দি দিয়ে ফেললেন। ধুমধাম করে সেবার পুজো হল সুরুলের কুঠিতে। আর কাকতালীয় ব্যাপার হোক বা না হোক, সত্যি সত্যি তার পর থেকে ব্যবসার হাল ফিরে গেল। পরের বছর মুনাফা হল দ্বিগুণ। আর কি পুজো বন্ধ হয়? সাহেব নিজে হুকুম দিলেন, প্রতি বছর দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হবে কুঠিতে।
জানা যায়, এই পুজোতে চিপস সাহেবের খরচ হত আন্দাজ পঞ্চাশ টাকা। পুজোর আয়োজন, অর্থাৎ প্রতিমা, পুরোহিত ইত্যাদিতে পড়ত সতেরো টাকা। পুজো উপলক্ষে কাপড় পেত সারা গ্রামের মানুষ। আর অষ্টমীর দিন পংক্তিভোজন। গ্রামের সব মানুষের নেমন্তন্ন হত সাহেবের কুঠিতে। ১৮২৮ সাল অবধি, যতদিন সাহেব বেঁচে ছিলেন, একবারও বাদ যায়নি দুর্গাপুজো।
এই আমাদের বাংলা। যেখানে বারবার ঘটেছে অভিনব সমন্বয়। যেখানে কোনও তথাকথিত বিধর্মী মানুষেরও বারণ ছিল না দেবীর আরাধনায়। আর এইসব বিচিত্র গল্প নিয়েই বাংলার উৎসব, বাঙালির উৎসব।