পাথুরিয়াঘাটার মল্লিকবাড়িতে পূজিতা হন দেবী সিংহবাহিনী। প্রায় দেড় ফুট উচ্চতার অষ্টধাতুর দেবীমূর্তি। বৈদ্যনাথ দে মল্লিকের নাম অনুসারেই এ বাড়ির পুজোর পরিচিতি। এই সিংহবাহিনীকে নিয়ে পরিবারের মধ্যে যে গল্প প্রচলিত আছে তার যোগ রয়েছে রাজা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে।
ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বৈদ্যনাথ মল্লিক। বেশ গভীর ঘুম। পাথুরিয়াঘাটা দে মল্লিকবাড়ির দাপুটে কর্তা তিনি। দিনভর হাজারও কাজের ঝক্কি। সেই সব সামলে রাতে যখন শুতে আসেন, সুষুপ্তিতে আচ্ছন্ন দু-চোখের পাতা। সেদিনও ঘুমোচ্ছিলেন বৈদ্যনাথ। আচমকা দেখলেন, তাঁর চোখের সামনে অপূর্ব জ্যোতি। চারিদিক যেন আলোয় আলো হয়ে উঠেছে। বৈদ্যনাথ ঠাহর করে দেখলেন, সকাল হয়নি। সেই আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে এক দেবীমূর্তির অঙ্গ থেকে। সিংহবাহিনী দেবী, চতুর্ভুজা। বিস্ময়ে হতবাক বৈদ্যনাথ যখন দেবীমূর্তির দিকে তাকিয়ে আছেন অপলক, তখনই ভেসে এল স্বপ্নাদেশ। দেবী ইচ্ছা প্রকাশ করে বললেন, এক পাহাড়ের গুহা থেকে তুলে এনে তাঁর মূর্তি নিজগৃহে প্রতিষ্ঠা করুন বৈদ্যনাথ। পূজা শুরু হোক তাঁর। করজোড়ে সেই আদেশ মেনে নিলেন বৈদ্যনাথ। ক্রমে মিলিয়ে গেল সেই আলো।
আরও শুনুন: দুর্গাপুজোয় চাঁদার ‘জুলুমে’ ওষ্ঠাগত প্রাণ… কীভাবে শায়েস্তা হয়েছিলেন সেকালের উদ্যোক্তারা?
জেগে উঠলেন বৈদ্যনাথ। দু-মুহূর্ত থমকে ভাবলেন, কী হল! কে এসেছিলেন! খানিক পরে বুঝতে পারলেন, এক অসামান্য দৈবাদেশ এসেছে তাঁর কাজে। অতএব সে কাজ তো সমাধা করতেই হবে। দেবীর বলে দেওয়া পথনির্দেশ মনে মনে ঝালিয়ে নিলেন বৈদ্যনাথ। তারপর চললেন, চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উদ্দেশে। সেখানে গিয়ে গুহায় দেবীমূর্তির দর্শনও পেলেন। হুবহু একইরকম দেখতে প্রতিমার দর্শন তিনি স্বপ্নে পেয়েছিলেন। অশ্বমুখ সিংহের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন দেবী রণংদেহী রূপে। তাঁর চার হাতে, শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বাণ। সিংহের পায়ের কাছে, একটি হাতির কাটা মাথা। মহিষাসুর, হাতির বেশে আক্রমণ করলে দেবী যখন তার শিরশ্ছেদ করেন, এই মূর্তি সেই গল্পই বলে।
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: দেবীপক্ষের আগে চলে পিতৃপক্ষ, এই সময়ে কোন কাজ অবশ্য পালনীয়?
মূর্তি আনতে গেলে বাধ সাধলেন এক মুনি। যিনি সেই সময় গুহাতে থেকে দেবীমূর্তি, পূজা ও পরিচর্যা করতেন। তিনি বৈদ্যনাথকে কিছুতেই সিংহবাহিনীর মূর্তি গুহা থেকে বাইরে নিয়ে যেতে দেবেন না। সুবর্ণবণিক বৈদ্যনাথ দে মল্লিক তখন তাঁকে নিজের কুলপরিচয় দিলেন। তাঁকে দেবীর স্বপ্নাদেশের কথাও জানালেন। কিন্তু মুনি কিছুতেই রাজি হলেন না। তখন বৈদ্যনাথও গুহার মুখে, এই গোঁ ধরে বসে রইলেন, যে সিংহবাহিনীকে না নিয়ে তিনিও ফিরে যাবেন না। এই যখন পরিস্থিতি তখন দেবী স্বয়ং অবতীর্ণ হলেন সমস্যার সমাধানে। সেদিন রাতেই তিনি গুহায় থাকা সেই মুনিকে স্বপ্নাদেশে জানালেন, তাঁর ইচ্ছার কথা।
শেষমেশ সেই আদেশেই কাজ হয়। এবং সিংহবাহিনী দে মল্লিক বাড়িতে আসেন এবং পুজো শুরু হয়। সে আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগেকার কথা।
পাথুরিয়াঘাটার মল্লিকবাড়িতে পূজিতা হন দেবী সিংহবাহিনী। প্রায় দেড় ফুট উচ্চতার অষ্টধাতুর দেবীমূর্তি। বৈদ্যনাথ দে মল্লিকের নাম অনুসারেই এ বাড়ির পুজোর পরিচিতি। এই সিংহবাহিনীকে নিয়ে পরিবারের মধ্যে যে গল্প প্রচলিত আছে তার যোগ রয়েছে রাজা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে। মল্লিকদের এই অষ্টধাতুর সিংহবাহিনী নাকি ছিলেন রাজা হর্ষবর্ধনের সময়ে পুষ্যভূতি বংশের কুলদেবী। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’ ও বাণভট্টের হর্ষচরিতে এই দেবীমূর্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। অষ্টধাতুর তৈরি সোনা রঙের বহুমূল্য চতুর্ভুজা সিংহবাহিনী মূর্তি। রাজারাজড়ার যুদ্ধ, লুটপাট, সাম্রাজ্যের হাতবদলে, দেবীমূর্তিরও স্থানান্তর হয় বারেবারে। তাই একসময় বিধর্মীদের হাত থেকে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে না পারলেও, কুলদেবীকে রক্ষা করার জন্য, এক পুরোহিত দেবীমূর্তিকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের এক গুহায় এনে লুকিয়ে রাখেন। এবং পুজোও করেন। আর স্বপ্নাদেশ পেয়ে, এ বাড়ির এক কর্তা বৈদ্যনাথ দে মল্লিক, সেই চন্দ্রনাথ পাহাড়ের গুহা থেকে সিংহবাহিনীকে বাড়ি নিয়ে এসে পুজো শুরু করেছিলেন। বিশ্বাস করলে সব আছে, বলে থাকেন অনেকে। মল্লিকেরা বিশ্বাস করেন, দেবী সিংহবাহিনী নিজের ইচ্ছায় এসেছেন তাঁদের পরিবারে।
দে মল্লিক-রা সুবর্ণ বণিক। বৈষ্ণব। তবে দেবীমূর্তি নিয়ে এসে প্রথমে হুগলির আদিসপ্তগ্রামের বাড়িতে প্রতি শনি-মঙ্গলবারে পাঁঠা বলি সহযোগে পুজো শুরু হয়। পরে তারা কলকাতায় এলে, সেখানেও পুজো চলতে থাকে। একবার, মল্লিকদের কুলদেবীর কথা লোকমুখে শুনে, শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং কলকাতা এসেছিলেন, মা সিংহবাহিনীকে দেখতে। সেসময় যদুনাথ মল্লিকের পাথুরিয়াঘাটার বাড়িতে সেই সিংহবাহিনীর পুজো ও নামগান হত বেশ ঘটা করে। শ্রীরামকৃষ্ণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেসব চাক্ষুষ করেছিলেন।
সময়ের সাথে সাথে মল্লিকদের শরিকরাও কলকাতার মূল বাড়ি থেকে ছড়িয়ে পড়েছেন সারা কলকাতায়। এক এক বছর পুজো হয় তাঁদের এক এক শরিকের বাড়িতে। দে মল্লিক বাড়িতে দুর্গাপুজোর সময় সিংহবাহিনীকে ছাগ নিবেদনের প্রথা এখনও রয়েছে। এছাড়া এ বাড়ির পুজোর বিশেষত্ব হল, প্রতি শনি-মঙ্গলবারে ডাব-চিনির ভোগ। এবছর এই পুজোর ৪১০ বছর, আয়োজিত হচ্ছে সল্টলেকের AE-91-এ।