ফুটবল আবেগের। ঘামের। যুদ্ধের। ফুটবল আত্মমর্যাদারও। বাঙালির ফুটবলের ইতিহাস তো শুধু খেলার ধারাবিবরণী নয়। তা বাঙালির লড়াইয়ের। সংগ্রামের। সেই পরম্পরা মেনেই, একটি মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলা যখন প্রতিবাদমুখর, সেই প্রতিবাদের আগুন বুকে জ্বালিয়ে নিল বাঙালির ফুটবলও।
সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল! বাঙালির প্রাণের সে-গান যে বাঙালির অন্তরেরই মর্মকথা, তা যেন আর একবার মনে করিয়ে দিলেন বাঙালির ফুটবলপ্রেমীরা। একটি মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলা যখন প্রতিবাদমুখর, তখন সেই আগুনটুকু বুকে জাগিয়ে রাখতে ভুললেন না তাঁরা। ডুরান্ড সেমিতে তাই দেখা মিলল টিফোর, আর সেখানে আরও একবার বোনের জন্য বিচার চাইল বঙ্গবাসী।
আরও শুনুন:
প্রতিবাদের জেরে ছাড়তে হয়েছিল ফুটবল, ময়দানকে রুখে দাঁড়ানো শিখিয়েছিলেন গোষ্ঠ পালও
ফুটবল আবেগের। ঘামের। যুদ্ধের। ফুটবল আত্মমর্যাদারও। বাঙালির ফুটবলের ইতিহাস তো শুধু খেলার ধারাবিবরণী নয়। তা বাঙালির লড়াইয়ের। সংগ্রামের। স্বাধীনতার। আত্মপ্রতিষ্ঠার। এবং আত্মগৌরবেরও। খালি পায়ের লড়াইয়ে ব্রিটিশদের কুপোকাত করার যে ইতিহাস ফুটবল মাঠেই লেখা হয়েছে, তা স্মরণ করে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামও। স্বদেশপ্রেমের যে জোয়ার সেদিন জেগেছিল, তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখেছিল প্রবল প্রতাপান্বিত ইংরেজও। সেই আশঙ্কারই ফলশ্রুতি কলকাতা থেকে রাজধানী স্থানান্তর। এই একটি বিন্দুকে যদি সূচনাচিহ্ন হিসাবে ধরা হয়, তবে মনে রাখতে হবে, বাঙালির ফুটবল বরাবরই হয়ে উঠেছে তার লড়াইয়ের ইশতেহার। তা শুধু বাঙালির আত্মগৌরব বজায় রাখার জন্য নয়; খেলার মাঠ যে ন্যায় আর সাম্যের বার্তা দেয়, তা ছড়িয়ে গিয়েছে খেলার বাইরেও। আসলে গ্যালারি তো মাঠের বাইরের অংশ নয়। তা মাঠের লড়াইয়ের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। আর মাঠেও যে শুধু বাইশজন ঘাম ঝরান, লড়াই করেন, তা তো নয়। মাঠের বাইরে থাকা অগণন দর্শক সেই লড়াইয়ে শামিল হন। খেলা, মাত্র নব্বই মিনিটের একটা আখ্যান তাই হয়ে উঠতে পারে জাতীয় ইতিহাসের উপাদান। যুগে যুগে খেলার মাঠ সেই প্রমাণ রেখেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না।
বরং এবার যেন খেলার মাঠ প্রসারিত হয়েছে বৃহত্তর নাগরিক সমাজে। সে ভুলে গিয়েছে মাঠের চিরকালীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা। গত ডার্বি বাতিল জুড়ে যে অভূতপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী থেকেছিল এই মহানগর, তার তুলনা সম্ভবত ভূ-ভারতে নেই। নিরাপত্তার কারণে ডার্বি বাতিল করেছিল পুলিশ। সমর্থকরা ঠিক করেছিলেন, প্রতিবাদ কর্মসূচি তাঁরা বজায় রাখবেন। পুলিশ যখন তাঁদের ঘিরে ধরেছিল, তখনই যেন সামনে এসেছিল মাঠের শক্তি। সেই শক্তি সম্মিলনের। হাতে হাত রাখার। মাঠের লড়াই ভুলে তিন প্রধানের সমর্থকদের জোট বাঁধার। আর সেই অভূতপূর্ব মহামিলনের সামনে দাঁড়িয়ে যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল পুলিশও। প্রিজন ভ্যান কি আর জনঅরণ্য রোধ করতে পারে! অতএব সেদিন বৃথা হয়েছিল পুলিশের ব্যবস্থা। কয়েক শতকের প্রাচীন এ শহর দেখল, চির প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সমর্থককে কাঁধে তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসছেন এক যুবক। দেখল, নির্ভয় কণ্ঠে স্লোগান দীপ্ত তরুণ-তরুণীদের। দলে দলে যাঁরা ভাগ হয়ে থাকেন, দলমত নির্বিশেষে এক হয়ে তাঁরা যে এমন মহাশক্তি হয়ে উঠতে পারেন, এমন নমুনা সচরাচর দেখা যায় না। অথচ সেই প্রায় বিরল দৃশ্য দেখা দিয়ে জানিয়েছিল, এ কলকাতা বেঁচে আছে, তার প্রতিবাদে, তার ফুটবলে।
তার পরেও ফুটবল মাঠ দেখেছে এই প্রতিবাদ দৃশ্য। না কোনও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টা সেখানে নেই। শুধু বাঙালি ফুটবলার এবং ফুটবলপ্রেমীরা একজোট হয়ে বলেছেন, যে ন্যক্বারজনক ঘটনা ঘটেছে, তার বিচার চাই। ডুরান্ড সেমিতেও কি তার আঁচ পড়া ব্যতিক্রমী কিছু? হওয়ার কথা ছিল না। তবে, নির্দেশিকা এল যে, টিফো নিয়েই ঢোকা যাবে না। পরে আদালতের নির্দেশে সেই অনুমোদন মেলে। আর তার পরেই দেখা যায় সবুজ-মেরুন গ্যালারিতে উঠে এল সেই টিফো, যা বলছে- ‘হাতে হাত রেখে এ লরাই, আমাদের বোনের বিচার চাই’। দল থেকে, জার্সির রং থেকে এই যে ‘আমাদের’ হয়ে ওঠা, এই যে হাতে হাত রেখে লড়াইয়ের বার্তা, এ অর্জন বাংলার ফুটবলের। এ উত্তরণ বাঙালিরই।
আরও শুনুন:
দেশের মা-বোনদের সুরক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী, তবে বিনেশের কথা মনে আছে কি?
বাঙালির সব খেলার সেরা যে ফুটবল, তা স্রেফ গানের কথা নয়। হৃদয়ে আন্দোলন জাগিয়ে আরও একবার সে কথা প্রমাণ করে দিলেন বাঙালি ফুটবলপ্রেমীরাই। আর তা দেখতে দেখতে বাঙালি যেন নিজের দিকে তাকিয়েই মনে মনে বলে উঠতে পারল, তাদের ভিতরেও জেগে আছে একটা ফুটবল মাঠ। যে মাঠ লড়াইয়ের, সংগ্রামের, ইতিহাসের। প্রতিবাদেরও। যে মাঠ অকুতোভয়। যে মাঠ হাতে হাত রেখে বোনের বিচার চাইতে পিছপা হয় না।
আমরা জানি, এই মাঠ ফুটবলের। জীবনেরও কি নয়!
(ছবিঋণ: সোশাল মিডিয়া)