পরাধীনতার কারাগার ভাঙার ডাক দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। একশো বছর পেরিয়ে সেই কারাগারের অর্থ বদলে নিল বাঙালি। পিতৃতন্ত্রের কারার লৌহকপাট ভাঙার ডাক হয়ে উঠল নজরুলের সেই গান।
নির্যাতিতার জন্য ন্যায়বিচার চেয়ে পথে নেমেছে বাংলা। দল মত পতাকা সরিয়ে পথে হাঁটছেন সাধারণ মানুষ। কারও গলা চিরে ঝলসে উঠছে স্লোগান, কেউ সবটুকু রাগ-দুঃখ উজাড় করে দিচ্ছেন রঙে-রেখায় কিংবা কলমে। যে যেভাবে প্রতিবাদ করছেন, তার সমস্তটা জুড়ে নিয়েই ভাষা পাচ্ছে নির্যাতিতার জন্য শোক আর দ্রোহ। সেই দ্রোহের ভাষ্য হয়েই সম্প্রতি উঠে এসেছে আরেক মেয়ের নাচের মুদ্রা। ‘কারার ওই লৌহকপাট/ ভেঙে ফেল কর রে লোপাট’, নজরুলের সেই পুরনো গানকে এই আবহে নতুন করে প্রতিবাদের ভাষা করে তুলেছেন মোক্ষ। তিনি অবশ্য বাংলারই মেয়ে, পৃথা সেনগুপ্ত। বিনোদন জগতে শক্ত জমি পেতে দক্ষিণে পাড়ি দিয়েছেন, সেখানে মোক্ষ নামেই তিনি পরিচিত। বিনোদুনিয়ায় আসার আগে ধ্রুপদি নৃত্যশিল্পী, শিক্ষিকা ছিলেন তিনি। তাই নাচকে অবলম্বন করেই নিজের প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে নিয়েছেন তিনি। নাচের তালেই ডাক দিয়েছেন কারার লৌহকপাট ভেঙে ফেলার। এ গানে রুদ্ররূপী শিবকে তাণ্ডব নাচতে আহ্বান করেন নজরুল, যাতে ‘কালবোশেখি’ ঝড়ে সব প্রাচীন ক্লেদ, সব অত্যাচারের দম্ভ ধ্বংস হয়ে নতুনের সৃষ্টি হয়। এই সময়েও, নারীর প্রতি ঘটে চলা অত্যাচার আর অত্যাচারের মানসিকতাকে ধ্বংস করার বার্তা নিয়েই এ গান ফিরিয়ে আনলেন মোক্ষ।
আরও শুনুন:
বাগে না পেলেই নারীকে ধর্ষণ? নন্দিনীর পরিণতিতে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ
১৯২১ সালের শেষে ‘কারার ওই লৌহকপাট’ গানটি লিখেছিলেন নজরুল। তাঁর ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থে গানটি সংকলিত হয়েছিল। অবশ্য ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর তোলার জেরে ১৯২৪ সাল নাগাদ এই কাব্যগ্রন্থটিকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ গানের ছত্রে ছত্রে সেই প্রতিবাদই জড়িয়ে- ‘কে দেয় সাজা, মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?’ এর প্রতি পদে ‘কারার লৌহকপাট’, ‘রক্তজমাট পাষাণ বেদী’-কে ‘লোপাট করা’, ‘উপড়ে ফেলা’-র ডাক, ‘ভীম কারার’ ‘ভিত্তি নাড়িয়ে’ দেওয়ার আহ্বান। ১৯৪৯-এ ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ ছবিতে এ গান প্রথম রেকর্ড করেন নজরুলের স্নেহধন্য গিরীন চক্রবর্তী, সেখানেও পরাধীনতার কারাগার ভেঙে ফেলার অভিযান। সেই গানই এবার ফিরে এল, অন্য অর্থ নিয়ে।
আরও শুনুন:
যৌন হেনস্তা, তবু মুখ খুলতে ভয় মেয়েদের… ‘দহন’ চিনিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ
আসলে শব্দের জাদু তো এখানেই যে তা মুহুর্মুহু রূপ বদলায়। একশো বছর আগে যে গান শাসকের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছিল, এখনও সে গান শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হয়েই ছড়িয়ে পড়ল বটে। তবে এ শাসক কেবল রাজনৈতিক শাসক নয়। যে সমাজের নিয়ন্ত্রণ পিতৃতন্ত্রের হাতে, সেখানে ক্ষমতার মসনদে বসে আছে পিতৃতন্ত্রই। যে নারীকে নিজের প্রতিপক্ষ বলে মনে করে, আর সেই কারণেই তাকে সর্বতোভাবে দমিয়ে রাখতে চায়। যাতে প্রতিস্পর্ধার ফুলকিটুকুও ছিটকে বেরোতে না পারে। সেই কারার লৌহকপাট ভাঙার ডাক ধারণ করেই এ সময়ে নতুন করে জেগে উঠল সেই পুরনো গান। সময়ের বদলে বদলে গেল তার অর্থ, তবে প্রতিবাদের ভাষা জেগে রইল চিরন্তন হয়েই।