মাতৃপক্ষ। মায়ের কাছেই সকল চাওয়া। চোখ বন্ধ করে। খোলা চোখে অবশ্য অপ্রাপ্তি। বিস্তর। মা আর মেয়েদের পাওনার ঘরে ঘরে আজও মস্ত ঢ্যাঁড়া। সেই কথা নতুন করে বলাই হোক এবারের অঞ্জলি মন্ত্রে। হয়তো এ অন্যরকম, অথবা এ-ই স্বাভাবিক।
নারীর স্বাস্থ্যে নজর পড়ুক, দেবীপক্ষে মায়ের কাছে দাবি জানালেন অন্তরা বন্দ্যোপাধ্যায়। পড়ে শোনাচ্ছেন, চৈতালী বক্সী। অলংকরণে দীপঙ্কর ভৌমিক।
পুজোর ছুটিতে দিনভর বিছানায় গড়ানো, সিনেমা-সিরিজে ডুব, ইচ্ছেমতো বেরিয়ে পড়া…
এমন কত না প্ল্যান প্রোগ্রাম সকলের! অথচ এই দিনগুলোতেও বাড়ির কাজের দিদির কিন্তু বিশ্রামের সময় নেই। সাতবাড়ি কাজ করে দিন চলে লালুর মায়ের। এ-পাড়ার পাল বাড়ির বাসন মেজে ঘর মুছেই ছুটতে হয় ও-পাড়ার দত্তদের বাড়ি, দত্তদের বাড়ি সেরেই যেতে হবে সিন্হাবাবুর ঘরে। কাজের মাঝে বাবুদের ঘরে দুটো বিস্কুট আর এক কাপ লাল চা হয়তো মেলে, কিন্তু টয়লেট ব্যবহারের অনুমতি মেলে কি? উঁহু। কাজের বাড়িতে বলেই দিয়েছে, ওখানে সে-সব চলবে না। অতএব, কাজের ফাঁকে রাস্তার মোড়ে পাবলিক শৌচালয়ই লালুর মায়েদের ভরসা। আজকাল পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের খরচ পুরুষদের জন্য দু-টাকা, কিন্তু কোন এক আশ্চর্য কারণে মেয়েদের টয়লেট ব্যবহারের মিনিমাম খরচ পাঁচ টাকা! কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের শ্রমসাম্যের স্লোগান অনেক শোনা যায়, কিন্তু পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই বৈষম্যবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিশেষ কোনও আওয়াজ তো ওঠেনি। তবু যা হোক, শহরে মফসসলে নোংরা, দুর্গন্ধে বমি উঠে আসা সেই পাবলিক টয়লেটই নাহয় বাবুদের বাড়ির গৃহকর্ম-সহায়িকাদের লজ্জা নিবারণ করছে, কিন্তু স্বাস্থ্য? ইউটিআই-এর কথা ছেড়েই দিই, মাসিকের দিনগুলোয় এই নরকসদৃশ পাবলিক টয়লেট তাঁদের কাছে হয়ে উঠতে পারে রোগের আঁতুড়ঘর।
মেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে এই সমস্যা কি শুধুই গৃহকর্ম সহায়িকাদের? স্কুল কলেজ অফিসে চাকুরিরতা প্রতিটি নারীরও কি এই একই সমস্যা নয়? এমনকি পরিবারে গৃহশ্রমের জাঁতাকলে আটকে থাকা প্রায় প্রতিটি মায়েদেরও কি এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না? আজও কি বাংলার প্রতিটি পরিবারের মেয়েদের হাতে স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দেওয়া গেছে? প্রেগন্যান্সির দিনগুলিতে সন্তানসম্ভবা মায়েদের মেয়েদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি আজও কি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? সংবাদপত্রে প্রায়ই এমন সব ইস্কুলের খোঁজ আজও মেলে, যেখানে বহুকাল কোনও লেডিস টয়লেটের অস্তিত্ব ছিল না। সেখানে হঠাৎ নতুন কোনও শিক্ষিকা যোগদান করলে তাঁকে দীর্ঘদিন পুরুষ সহকর্মীর টয়লেট ভাগ করে নিতে হয়েছে। বহু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেডিজ টয়লেটে ঢুকতে হলে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে সাবধানে মেঝেতে পা রাখতে হয়। আজও সেখানে মেনসট্রুয়েশন হাইজিন মেনটেন তো দূরের কথা, টয়লেট ব্যবহারের পর পর্যাপ্ত জলটুকু দেওয়ার ব্যবস্থাও কি ঠিকঠাক আছে?
সম্প্রতি আর. জি. কর হাসপাতালে ঘটে যাওয়া ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সেখানে কর্মরত মহিলা ডাক্তারদের জন্য পরিচ্ছন্ন টয়লেট নেই, বিশ্রামের জন্য কোনও উপযুক্ত ঘর নেই। বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না সেখানে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কিংবা আউটডোরে দৈনন্দিন দেখাতে আসা অসুস্থ মহিলাদের জন্য বরাদ্দ টয়লেট কতটা নারকীয় হতে পারে!
মোদ্দা কথা হল, নারী-স্বাস্থ্যের প্রতি সমাজের তেরছা নজর আজও বহাল তবিয়তে বজায় আছে। রাজ্য সরকার নিত্যনতুন প্রকল্প আনছেন বটে, কিন্তু তার প্রয়োগের জায়গাটি আদৌ কতটা বাস্তব হচ্ছে এই রাজ্যের তিলোত্তমাদের জন্য? এখন নয়, বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই ধীরে ধীরে নারীর স্বাস্থ্য সচেতনতার দিকগুলি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে শুরু করেছিল। মেয়েদের ঋতুচক্র নিয়ে সচেতনতা, মাসিককালে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সঠিক ব্যবহার এবং যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রক দপ্তর ২০১১ সাল থেকে ‘মাসিক স্বাস্থ্যবিধি’ নামক একটি প্রকল্পের সূচনা করেছিল। মাসিকের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে কিশোরীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকার কিশোরীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার বৃদ্ধি ও একইসঙ্গে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার সুনিশ্চিত করাই ছিল এর লক্ষ্য। কিন্তু এই সমস্ত উদ্যোগগুলি সমাজের সর্বস্তরের মহিলাদের কাছে আজও যথাযথভাবে পৌঁছয়নি। প্রান্তিক গ্রামগুলিতে শিক্ষার অনগ্রসরতা এবং দারিদ্র্য একটা বড় কারণ তো বটেই, কিন্তু রূপায়নের ক্ষেত্রে সরকারি স্তরে সদিচ্ছা ও পরিকল্পনার অভাবও বড়ো কম ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে ২০১২ সালে রাজ্য সরকার ‘দিশা’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করার কথা জানিয়েছিল। এই প্রকল্পের আওতায় হাসপাতাল চত্বরে আশাকর্মীদের জন্য বিশ্রামাগারের সঙ্গে শৌচাগার নির্মিত হবে– এমন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রকল্পের যথার্থ রূপায়ণ সর্বত্র হয়েছে কি? মহানগর কলকাতার বুকে বিগত কয়েকবছরে কিছুদূর অন্তর ‘সুলভ শৌচালয়’ গড়ে উঠেছে, কিন্তু তার অধিকাংশই ব্যবহার-অনুপযুক্ত। চলতি বছরে খাস কলকাতায় মহিলাদের জন্য ভ্রাম্যমাণ শৌচালয় তৈরির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই বিষয়টিও আর ততটা গুরুত্ব নিয়ে দেখা হয়নি। তাই মেয়েদের শৌচালয় নিয়ে অব্যবস্থার চিহ্ন আজও সর্বত্রই রয়েছে। পরিচালকের মর্জি অনুসারে সেখানে মাঝে মাঝেই তালা ঝোলে, অজ্ঞাত কারণে মেয়েদের শৌচালয় ব্যবহারের খরচ পুরুষদের তুলনায় আড়াইগুণ বেশি হয়ে যায়।
মনে রাখা দরকার, মেয়েদের শৌচালয় শুধু মলমূত্র ত্যাগের জায়গা মাত্র নয়, তাতে স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ হাইজিন মেনটেনের প্রয়োজনীয় কিছু বিশেষ সুবিধা থাকা অনিবার্য। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিসহ নানান কর্মক্ষেত্রের শৌচালয়গুলিতে বিনামূল্যে, নিদেনপক্ষে স্বল্প মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করা প্রয়োজন। এমনকি বহু শৌচালয়গুলিতে পর্যাপ্ত জল থাকে না, তাই শৌচাগারগুলি সহজেই ইউরিন ইনফেকশনের আখড়া হয়ে ওঠে। আর ঠিক একারণেই অনেক কর্মজীবী মহিলা বহুসময়েই শৌচাগারে যেতে বিমুখ হন। আর দীর্ঘ সময় মূত্রত্যাগ না করার যাবতীয় শোধ তোলে শরীর। শারীরিক সমস্যা ছাড়াও, শৌচাগারের অভাবে অধিকাংশ মহিলা মানসিক চাপ এবং আত্মবিশ্বাসহীনতার শিকার হন। ঋতুকালীন সময়ে স্কুল, কলেজ, কর্মক্ষেত্রে গিয়ে তাঁরা চূড়ান্ত অসুবিধার সম্মুখীন হন।
শুধু তো ঋতুকালীন অবস্থা নয়, পাশাপাশি রয়েছে গর্ভকালীন সমস্যাও। গর্ভধারণের আগে অথবা পরে মহিলাদের যে দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তার উপযুক্ত সুরক্ষা-কাঠামো এই রাজ্যে এখনও তৈরি হয়নি। মাতৃত্বকালীন ছুটির সুযোগ বেসরকারি ক্ষেত্রে আজও সমান নয়। এমনকি তা কর্মীর অধিকারও নয়। বরং বহু সময়েই তা বস-এর মর্জির উপর নির্ভর করে। আবার সরকারি কর্মক্ষেত্রগুলিতে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়া, পুনরায় যোগদান এবং ছুটির মধ্যবর্তী সময়ে অন্য কর্মীকে নিয়োগ করা– এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির শর্তগুলি জটিল এবং বহুস্তরীয় নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ। সরকারি ক্ষেত্রগুলিতে সন্তানের লালনপালনের জন্য দুবছরের ‘চাইল্ড কেয়ার লিভ’ নামক একটি বিশেষ ছুটির বন্দোবস্ত থাকলেও ছুটি মঞ্জুরের বিষয়টি বহু সময়েই কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত থাকে। এর ফলে সংকটের মুখে পড়তে হয় মূলত কর্মরতা মহিলাদেরই, অনিবার্যভাবে তার প্রভাব পড়ে তাঁদের পরিবার পরিকল্পনাতেও।
এই সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য থেকে বোঝা যায়, শুধুমাত্র অশিক্ষা অথবা দারিদ্র্য নয়, আমাদের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার প্রাচীন ও বহমান ইতিহাসটিও নারীস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব না দেওয়ার ক্ষেত্রে কম দায়ী নয়। সে ইতিহাসের দিকে ফিরে আমরা দেখি,
নারী সন্তানের জন্ম দেবে, কিন্তু তার স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা হবে না, এমনটাই চলতি অভ্যাস। আবার এই খেয়াল না-রাখার, অযত্নের সপক্ষে সাফাই জারি, এমনকি নারীর এই যন্ত্রণাকে মহিমান্বিত করার প্রক্রিয়াটিও চালু। খোদ ঠাকুরবাড়ি, প্রগতিশীলতার প্রথম আলো যেখানে ছড়িয়ে পড়েছিল বলে আমরা মনে করি, সেখানেও একই অব্যবস্থা। একদিকে শাড়ি-ব্লাউজ পরার আধুনিকতা, অন্যদিকে প্রসূতি অসুখ। এই যে অসংগতি, এই প্রবণতা আজকের প্রগতিরও ভিতরকার অসুখ। ফলত, নারীর সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দিয়েছে মেল গেজের সমাজ আর স্বাস্থ্যকে ততটাই দূরে ঠেলে দিয়েছে। তাই, নারীকে দেবী হতে হয়। যিনি মানবী চাহিদার ঊর্ধ্বে। নারী মানবী হলেই, প্রাকৃতিক শারীরিক চাওয়াপাওয়ার কথা তুললেই এ সমাজ ভারী অসুবিধায় পড়ে যায়।
আপাতত দেবীপক্ষে মেতে উঠেছে বাঙালি। শহরজুড়ে আলোর রোশনাই। রাজপথ থেকে অলিগলি দেবীদর্শনের ভিড়। অন্ধকারের ফাঁকফোঁকর দেখলেই পুরুষের দল হয়তো আড়ালে-আবডালে প্যান্টের জিপ খুলে দাঁড়িয়ে পড়েন, কিন্তু মেয়েরা? সেই ব্যস্ত ভিড়ের মধ্যে থেকে কত রক্তমাংসের দেবীর চোখ যে রাস্তার মোড়ে একখানি পাবলিক টয়লেট খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছে, তা কি আমরা লক্ষ করেছি? আজ তাই, এই মাতৃপক্ষের অর্চনায় আসুন, রক্তমাংসের মেয়েদের জন্যে, একটু বাড়তি যত্ন চেয়ে আওয়াজ তুলি।