পরিব্রাজক-পর্যটকেরা পায়ে হেঁটে দেশকে চিনেছেন বরাবরই। সেই পদযাত্রাই কখনও কখনও হয়ে উঠেছে একরকম রাজনীতির বয়ান। আবার এ দেশের রাজনীতিতেও পদযাত্রা এক রাজনৈতিক ভাষ্য হিসেবে হাজির হয়েছে বারেবারেই। সেই পরম্পরা বেয়েই এখনও রাজনীতির বয়ানে লগ্ন হয়ে থাকছে পথচলা। পথ হয়তো বদলাচ্ছে, তবে যাত্রা কিন্তু থামছে না।
হেঁটে দেখতে শিখুন, ঝরছে কী খুন দিনের রাতের মাথায়- রাজনীতিকদের গোড়ার পাঠ হয়তো হতে পারে এ কথাই। দেশকে না চিনলে, দেশের মানুষকে না চিনলে রাজনীতি হয় না। আর ঘরে বসে সে চেনা সম্পূর্ণও হয় না। ভারতের রাজনীতি কিন্তু প্রথম থেকেই এ কথা বুঝিয়েছে। বুঝিয়েছে, ভারতের মতো বহু বৈচিত্র্যের বিস্তার যে দেশে, সেখানে সেই বৈচিত্র্যকে চিনতে হয় দেশের মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে। দেশের মানুষের হাত ধরতে ধরতে চলতে হয় পথ, আর সেইভাবে মানুষকে জুড়ে নিয়েই জড়ো হয় দল।
আরও শুনুন:
‘গরিবি’ হটিয়ে ‘আচ্ছে দিন’ এল কি? দশে মিলে দেশের রাজনীতি চেনাল স্লোগানেরা
আসলে ভারতীয় রাজনীতিতে যাত্রা, অর্থাৎ পদযাত্রা চিরকালই তাৎপর্যপূর্ণ। সম্ভবত, তার মধ্যে যে কৃচ্ছ্রসাধন আছে, সংকল্প আছে, তা ভারতীয় গণস্মৃতিতে প্রাচীন তীর্থযাত্রার মূর্ছনা তৈরি করে বলেই। দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসেও দেখা গেল, বারেবারে উঠে এল এমন কয়েকটি শব্দ, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এহেন চলা।
ভারত জোড়ো যাত্রা।
ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা।
নবজোয়ার যাত্রা।
সবই একেকটি রাজনৈতিক যাত্রা। ভোটের ফল প্রকাশের পরই শোনা গিয়েছে ধন্যবাদ যাত্রার ঘোষণা। আবার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে না জুড়েও প্রবলভাবে রাজনৈতিক হয়ে থেকেছে কৃষকদের লং মার্চ, কিংবা সদ্য ঘোষিত ইনসাফ যাত্রা। এ দেশের রাজনীতিতে পদযাত্রা এক রাজনৈতিক ভাষ্য হিসেবে হাজির হয়েছে বারেবারেই। সেই পরম্পরা বেয়েই এখনও রাজনীতির বয়ানে লগ্ন হয়ে থাকছে পথচলা। পথ হয়তো বদলাচ্ছে, তবে যাত্রা কিন্তু থামছে না।
আরও শুনুন:
কোবরা, জলঢোঁড়া, চন্দ্রবোড়া… রাজনীতি যেন সর্পমঙ্গল কাব্য
এ দেশের ইতিহাসে যাত্রার পরম্পরা তো সত্যিই নতুন কিছু নয়। পরিব্রাজক-পর্যটকেরা পায়ে হেঁটে দেশকে চিনেছেন বরাবরই। সেই পদযাত্রাই কখনও কখনও হয়ে উঠেছে একরকম রাজনীতির বয়ান। শ্রীচৈতন্য যখন পায়ে পায়ে চলে যাচ্ছেন এক স্থান ছেড়ে আরেক স্থানের দিকে, আর তাঁর সেই যাত্রা সেইসব স্থানকে জুড়ে নিচ্ছে প্রেমের নামে, সে যাত্রা কি কেবল ভক্তির? ক্ষমতা আর হিংসার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক পালটা প্রতিরোধ নয়? তার সঙ্গে নাহয় স্পষ্ট কোনও দলীয় রাজনীতির যোগ ছিল না। কিন্তু সেই সাংগঠনিক রাজনীতিই এ দেশে বারেবারে পদযাত্রাকে জুড়ে নিয়েছে নিজের সঙ্গে।
১৯৩০-এর ১২ মার্চ, ব্রিটিশ সরকারের লবণের উপর কর বসানোর প্রতিবাদে গুজরাতের উপকূলবর্তী গ্রাম ডান্ডি থেকে অভিযান শুরু করেন মহাত্মা গান্ধী। সত্য ও অহিংসা, এই দুই আদর্শের উপর ভর করে চলেছিল সেই পদযাত্রা। এর প্রায় শতবর্ষের কাছাকাছি সময়ে এসে আরও এক পদযাত্রা দেখল দেশ, তারও মূল কথা হয়তো এই আদর্শই। যে বহুমাত্রিকতা এ দেশের আত্মার সত্য, যে সত্য নিয়ত ক্ষুণ্ণ হচ্ছে ধর্মীয় একমাত্রিক রাজনীতির মারে, সেই সত্যকেই যেন ফেরাতে চাইল ভারত জোড়ো যাত্রা। দেড়শো দিন, কেরল থেকে জম্মু ও কাশ্মীর অবধি ১৪টা রাজ্য, চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা- এই মাপের কোনও রাজনৈতিক পদযাত্রা ভারত এর আগে দেখেনি। সেই যাত্রা শুরুর আগেই, যাত্রার আহ্বায়ক রাহুল গান্ধী জানিয়েছিলেন, তিনি পথে নামছেন ভারতের বহুত্ববাদী আত্মাটিকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য। পাঁচ মাস ধরে সেই বার্তাই দিয়ে রাহুল বারেবারে বলেছিলেন, ভারত কী ছিল, এবং ইদানীং কালের এই বিদ্বেষের অন্ধকার পেরিয়ে ভারত কী হয়ে উঠতে পারে। এই এক যাত্রাতেই রাহুল থেমে যাননি, এরপর আরও একবার পথে নামলেন তিনি। ভারত জোড়ো যাত্রা-র যে নয়া পর্ব, তার পোশাকি নাম হল ‘ভারত ন্যায় যাত্রা’। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেন, যাত্রার নামে ‘ন্যায়’ শব্দটি যোগ করে রাহুল তাঁর রাজনীতিকে আরও কেন্দ্রীভূত এবং সংহত করে দিয়েছিলেন। এ যাত্রা স্পষ্ট করে এ কথাই বলছিল যে, দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিই আসলে অধর্ম। আসলে সাম্প্রতিক কালে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতিতে ধর্মের অর্থ। যে ধর্ম কেবল আচার-অনুষ্ঠান নয়, তা নীতি এবং ন্যায়ও। নীতিহীনতা অধর্ম, অন্যায় অধর্ম। আর তাই ধর্মের তাৎপর্য যদি কারও কারও হাতে গ্লানিপূর্ণ হয় ওঠে, তবে, দেশের মানুষেরই কর্তব্য যে, ধর্মকে পুনরুদ্ধার করা। অবশ্যই তা ন্যায় ও নীতির অর্থে। ন্যায়ের পক্ষে সওয়াল করলেই তা হয়ে উঠবে প্রকৃত ধর্মপালন।
এই সময়কালেই এক যাত্রার সাক্ষী হয়েছে বাংলাও। তা অবশ্য সম্পূর্ণভাবেই রাজনৈতিক। ভোটের কথা মাথায় রেখেই নব জোয়ার যাত্রা শুরু করেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ৫১ দিনে অতিক্রম করেছিলেন সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার পথ। কিন্তু ভোট থাক আর যাই থাক, একটি বিষয়কে কিন্তু সামনে এনে দিয়েছিল এই দুই যাত্রাই। জনতার সঙ্গে জননেতার মাঝে যে মঞ্চের উচ্চাবচ দূরত্ব থাকার কথা নয়, বরং দুপক্ষের মধ্যে কথা বলার সংযোগটুকু থাকাটাই জরুরি, এই দুই যাত্রাই সে ভাবনাকে সামনে রেখেছিল। রাহুল যতই বলুন না কেন, ভোটের হিসেবের সঙ্গে এ যাত্রার যোগ নেই, তবে ভোটের ফল প্রকাশের পর কংগ্রেস যে ধন্যবাদ যাত্রার ঘোষণা করেছে, তার সঙ্গে ভোটপ্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা মিশে আছে বইকি।
আরও শুনুন:
মাছ, মাংস, মিষ্টি… স্বাদের আহ্লাদও আসর মাতাচ্ছে ভোট-রাজনীতির
এই ধন্যবাদ যাত্রার সমসময়েই ঘোষিত হয়েছে আরও এক যাত্রার কথা। কঙ্গনা রানাউত-এর কুকথার প্রতিবাদে চড় মারার জেরে সিআইএসএফ-এর যে মহিলা জওয়ান বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁর জন্য ন্যায়বিচার চেয়েই ইনসাফ যাত্রার ডাক দিয়েছেন কৃষকেরা। এমনিতেও বিগত কয়েকটা বছরে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, চাষের জমিতে খেটে খাওয়া পায়ের জোর কতখানি। রাজধানী পর্যন্ত লং মার্চ করে যখন তাঁরা নিজেদের জন্য ন্যায়বিচার চেয়েছিলেন, তখন থেকেই যাত্রার প্রতি অক্ষরে প্রতিবাদ বুনে দিয়েছেন তাঁরা। সে যাত্রার সঙ্গে দলীয় রাজনীতির যোগ নেই, কিন্তু সে যাত্রা প্রতি পদক্ষেপে রাজনৈতিক। আর এই যে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির মানুষেরা যাত্রাকেই তাঁদের ভাষ্য করে তুলছেন, সেখানেই মূর্ত হয়ে উঠছে এ দেশের বহুমাত্রিক রূপটি। আর সেখানেই জারি থাকছে ভারতবর্ষের আত্মিক যাত্রাটিও।